রবিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫৩ পূর্বাহ্ন

হাওড় পাড়ের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রেক্ষিতে তাহিরপুর

রিয়াজ উদ্দিন : অনেকে মনে করেন তাহিরপুরে হাওর পাড়ের নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো অনেকাংশে ভঙ্গুর। হাওর যেমন চতুর্দিক দিয়ে তাহিরপুরকে বেষ্টন করে আছে ঠিক তেমনি নানান সমস্যা বেষ্টন করে আছে তাহিরপুরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে। এখানকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে যেসব সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক স্বল্পতা, প্রাইভেট বাণিজ্য, অভিভাবকদের অসচেতনতা, দুর্নীতি, নেই পাঠাগার ও বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা, নেই কোন সাংস্কৃতিক চর্চা।

অবকাঠামোগত সমস্যা মফস্বলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান। তবে তাহিরপুরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এই সমস্যাটি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যে বেঞ্চে বসার কথা তিন থেকে চার জন সেই বেঞ্চে বসে ক্লাস করছে পাঁচ থেকে ছয় জন। যে রুমে বসে ক্লাস করার কথা অর্ধশত শিক্ষার্থীর সেই রুমে বসে ক্লাস করে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী। এভাবে গাদাগাদি করে বসে ক্লাস করার ফলে শিক্ষার্থী তার মনোযোগ হারায় যার প্রভাব খুবই নেতিবাচক। অনেক ক্লাসে শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী থাকলেও নেই কোন মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা যে কারণে অনেক সময় এমনো হয় যারা পেছনে বসে ক্লাস করে তারা শুধু বুঝতে পারে শিক্ষক কিছু পড়াচ্ছেন কিন্তু কি পড়াচ্ছেন তা আর তাদের কান পর্যন্ত আসে না। এসব সমস্যার কারণে শিক্ষক তাঁর পাঠদান ঠিকমতো দিতে পারেন না যার ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

শিক্ষক স্বল্পতাঃ শ্রেণীকক্ষের পাঠদান দেওয়া থেকে শুরু করে, একজন শিক্ষার্থীকে নানান সমস্যা থেকে পরিত্রাণ এর পথ যিনি দেখান, যিনি একজন শিক্ষার্থীকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেন তিনি হলেন শিক্ষক। তাহিরপুরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো চরম মাত্রায় ভুগছে শিক্ষক স্বল্পতা রোগে। শিক্ষক স্বল্পতার পরিমাণটা কেমন তা জেলা সদরের কোন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করলেই হয়তো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার জেলা (সুনামগঞ্জ) সদরের সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কথাই যদি বলেন ঐ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক আছেন ত্রিশ জনেরও বেশি অন্যদিকে তাহিরপুরের অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন গড়ে আট থেকে দশ জন । শিক্ষক স্বল্পতার কারণে একজন শিক্ষকের প্রতিদিন টানা ৪-৫টি ক্লাস নিতে হয়। এমনো অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে যেখানে অফিস সহকারী পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ক্লাস নিয়ে থাকেন। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে একজন শিক্ষক নিচ্ছেন একাধিক বিষয়ের উপর ক্লাস যার ফলে দেখা যায় ধর্ম বা কৃষি শিক্ষার শিক্ষক নিচ্ছেন ইংরেজি বা গনিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্লাস। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রাইভেট বাণিজ্যঃ যেসব শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পাঠদান ভালোভাবে না বুঝে অথবা বুঝলেও ভালোভাবে আয়ত্ত করতে চায় সেক্ষেত্রে প্রাইভেট পড়াটা একটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু যখন প্রাইভেট পড়াটা শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যায়,শিক্ষক যখন ক্লাস বিমুখ হয়ে প্রাইভেটমুখী হয়ে যান তখন ইহা একটি ব্যাধিতে রুপ নেয়।

আর সেই ব্যধিতে ভুগছে তাহিরপুরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। অনেক অভিভাবক মনেকরেন প্রাইভেট পড়ানো ছাড়া তার সন্তানের লেখপড়ার কোন ধরণের উন্নতি সম্ভব নয়। আবার অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা নানান কারণে প্রাইভেট পড়তে পারে না তারা মনে-মনে ধরে নেয় তাদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না কারন তাদের বিশ্বাস পরিক্ষায় ভালো ফলাফল করা হোক আর অন্য যেকোন সফলতা হোক প্রাইভেট না পড়লে তা অর্জন সম্ভব নয়। অনেক শিক্ষকের নামে এমনো অনেক অভিযোগ শুনা যায় যে শিক্ষক নাকি ক্লাসে ভালোভাবে পড়ান না যেন শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়।

অভিভাবকদের অসচেতনতাঃ তাহিরপুরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের লেখপড়া সম্পর্কে পুরোপুরি খেয়াল রাখেন না যা তাদের সন্তানের লেখাপড়ায় নেতিবাচক ও বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং এক ধরণের প্রতিবন্ধকতার মতো কাজ করে। অন্যদিকে অভিভাবকদের এধরণের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে চলে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতি যেমন বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ফি এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা আদায়, বার্ষিক পরিক্ষার খাতা মূল্যায়ণে স্বজনপ্রীতি, উপবৃত্তি থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের অনান্য সুযোগ সুবিধা বন্টণে স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ গ্রহণ।

বিজ্ঞান বিভাগ এর অনুপস্থিতিঃ তাহিরপুরের অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেখানে সাধারন বিজ্ঞান বই পড়ানোর শিক্ষক পাওয়া যায় না সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা অনেক দূরের বিষয়। তবে অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রাণবন্ত চেষ্টায় খোলা হয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ যা তিন থেকে চারজন শিক্ষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে কোনরকম ভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন। কম্পিউটার ল্যাব থাকবে, প্রজেক্টরে ক্লাস হবে এগুলো এখনো অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে নিছক কল্পনা মাত্র।

নেই পাঠাগার এবং সাংস্কৃতিক চর্চাঃ অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নেই কোন পাঠাগার। অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা পাঠাগার শব্দটির সাথে অপরিচিত। বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ ও জ্ঞান অর্জনের জন্য পাঠ্যপুস্তকের বাহিরেও যে বিভিন্ন বই পড়তে হয় তা এখনো অনেক শিক্ষার্থীর অগোচরেই রয়ে গেছে। আর সাংস্কৃতিক চর্চা বলতে বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসে দুটি অনুষ্ঠানের বাহিরে আর কোন কার্যক্রম চোখে পড়ে না।

তবে আশার কথা হলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে শিক্ষা যেখানে শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে । অন্যদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কীভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত নানান সমস্যার দ্রুত সমাধান করা যায় এবং শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি করা যায়। হয়তো করোনা পরবর্তী সময়ে খুব দ্রুত তাহিরপুরের হাওর পাড়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো সকল সমস্যা কাটিয়ে এগিয়ে চলবে দুর্বার গতিতে।

লেখকঃ রিয়াজ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী  

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com