মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪৫ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :

বিমানে অস্থিরতা

তরফ নিউজ ডেস্ক : রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চলছে অস্থিরতা। ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ, কর্মকর্তাদের ওএসডি, বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা ও লন্ডন রুটের টিকিট কেলেঙ্কারিসহ নানা কারণে এমন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিমানের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, বিমানের দুর্নীতি নামক ভূত তাড়াতে পারলে প্রতিষ্ঠানটি ভালো চলবে। লাভের
মুখ দেখবে। মন্ত্রণালয়ের এবারের পদক্ষেপ কিছুটা হলেও ফল দেবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অনিয়মের অভিযোগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিপণন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এবং লন্ডন থেকে আসা কান্ট্রি ম্যানেজারকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়েছে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। একই মাসের শেষ কর্মদিবসে হঠাৎ করেই মেয়াদ পূরণের আগেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব থেকে এএম মোসাদ্দিক আহমেদকে সরিয়ে দেয় পরিচালনা পর্ষদ।

গত বৃহস্পতিবার পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি পাঠিয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) ১০ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আওতায় পরার আশঙ্কায় রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বড় একটি অংশ।

অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে ইতিমধ্যেই বিমানের ১৪৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জবানবন্দি নিতে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। এরই মধ্যে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে ৩ পরিচালকসহ ৫ কর্মকর্তার। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রয়াত্ব এয়ারলাইনস সংস্থাটিতে অস্থিরতা বাড়ছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে অস্থিরতার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারী মানবজমিনকে বলেন, কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতার বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। এটা ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই ভাল বলতে পারবেন। বিমানের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৭ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার আগ পর্যন্ত বিমানের লোকসান ছিল ১ হাজার ১৮২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার পর ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৫ কোটি ১৯ লাখ ও ২০০৮-০৯-এ ১৫ কোটি টাকা মুনাফা করে সংস্থাটি।

তবে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে আবারো লোকসান শুরু হয়। ওই অর্থবছর ৮০ কোটি, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯১ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছর ৬০০ কোটি ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২১৪ কোটি টাকা লোকসান দেয় বিমান। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিমানের লোকসান হয় ১৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে গত দুই অর্থবছর লাভ করতে সমর্থ হয় বিমান। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩২৪ কোটি ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৭৬ কোটি টাকা মুনাফা করে বিমান। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিমান থেকে আয় হয় ৪ হাজার ৫৫১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ব্যয় হয় ৪ হাজার ৫০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে ৪৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা লাভ হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ২০১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিমানের আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৯৩১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১৩৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। এদিকে বিমানের লন্ডন স্টেশনের সাবেক কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আড়াই হাজার ফ্রি টিকিট বিক্রি করে ১৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। শফিকুল ইসলামের চার বছরের মেয়াদে লোকাল স্টেশন  থেকে দুই হাজার ৪৭২টি ফ্রি টিকিট ইস্যু করা হয়েছে। যাদের সবাই লন্ডন থেকে ঢাকা এসে আবার লন্ডনে ফেরত গেছেন। এর মধ্যে বিজনেস ক্লাসের যাত্রী ছিলেন ১ হাজার ১৩৬ জন এবং ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী ১ হাজার ৩৩৬ জন। গত ২৪শে মার্চ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের টিকিট বিক্রি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় কার্যবিবরণীতে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। ওই সভায় বিমান সচিব বলেন, বিমানের রিজার্ভেশন বা টিকিট বিক্রি কার্যক্রম সম্পূর্ণ অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

বাস্তবে সামান্য কিছু টিকিট অনলাইনে সচল রেখে বাকি টিকিট ব্লক করে রাখা হয়। অথচ নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা দিলে টিকিট পাওয়া যায়। এভাবে টিকিট বিক্রি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। অনেক সময় অনেক সিট খালি রেখে বিমান যাত্রা করে। টিকিট নিয়ে এমন দুর্নীতির বিষয়ে জানার জন্য গেল মাসের প্রথম দিকে বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহম্মেদ ও পরিচালক (মার্কেটিং এন্ড সেলস) আশরাফুল আলমকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে নেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সামনে এমডি বলেন, সিট রিজার্ভেশন বা টিকিট বিক্রির মতো এত সূক্ষ্ম বিষয়ে তিনি অবহিত নন। এসব বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। পুরোটাই মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস বিভাগের ওপর তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। এরপরই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) আশরাফুল আলম ও লন্ডন থেকে আসা কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলামকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে বিমান কর্তৃপক্ষ। বিমান বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিমানের দুই কর্মকর্তাকে সরানোর কিছুদিনের মধ্যে গত ৩০ শে এপ্রিল নানা অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে সরানো হয় এ এম মোসাদ্দিক আহমেদকে। বিমানের পরিচালনা বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে এ দায়িত্ব থেকে সরানো হয়।

এমডি অপসারনের আদেশে নতুন এমডি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত বিমানের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন্স) ক্যাপ্টেন ফারহাত হাসান জামিলকে ভারপ্রাপ্ত এমডি’র দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এদিকে গত ২রা মে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল মুনীম  মোসাদ্দিক আহম্মেদসহ ১০ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিমানে পাইলট নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সাবেক এমডি ছাড়া নিষেধাজ্ঞা পাওয়া বিমানের অন্য কর্মকর্তারা হলেন- গ্রাউন্ড সার্ভিস সুপারভাইজার জি এম জাকির হোসেন, মো. মিজানুর রহমান ও এ কে এম মাসুম বিল্লাহ, জুনিয়র গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার মো. মশিকুর রহমান, কমার্শিয়াল সুপারভাইজার মো. রফিকুল আলম ও গোলাম কায়সার আহমেদ, কমার্শিয়াল অফিসার মো. জাওয়েদ তারিক খান ও মাহফুজুল করিম সিদ্দিকী, জুনিয়র কমার্শিয়াল অফিসার মারুফ মেহেদী হাসান। বিমান সূত্রে জানা গেছে, বিমানের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির পর অস্থিরতা বেড়েছে। বিপনন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারিরা আছেন আতঙ্কে। তবে শুদ্ধি অভিযান চালানো শুরু করার পর বিমানের আয় দিন দিন বাড়ছে। গত দুই মাসে প্রায় ৭৩ কোটি টাকা আয় বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানের রন্ধে রন্ধে দুর্নীতি। তাই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করলে প্রতিষ্ঠানটি আরও বেশি লাভের মুখ দেখবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com