বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন

আরেক মুক্তিযুদ্ধ

বীরমুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছে পুটিজুরী এস.সি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

।। পংকজ কান্তি গোপ ।।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি; মুক্তিযুদ্ধের অগ্নি ঝরা দিনগুলো কেমন ছিল তাও জানি না। তবে বিভিন্ন সময়ে বীর মুক্তিযুদ্ধাদের কাছাকাছি যাবার সুযোগ হয়েছে আমার। যখন পত্রিকায় লিখতাম তখনও কয়েকবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছি। একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থাপনাও করেছি । কিন্তু, ওইসব করতে গিয়ে প্রতিবেদনের নান্দনিকতা আর অনুষ্ঠানের শ্রী-বৃদ্ধি’র ওপরই নজর দিতে হয়েছে বেশী। বাঙলার সাহসী সন্তানদের মনের গহীনে ঢুকা সম্ভব হয়নি।

তবে এবার এই সুযোগটি পেয়েছি। খুব কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা শুনেছি আর শিউরে শিউরে উঠেছি বারবার। সম্প্রতি, দেশের প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি চমৎকার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধকে জানি’ শীর্ষক এই কার্যক্রমে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ তাদের স্মৃতিচারণ করবেন শিক্ষার্থীদের কাছে। শিক্ষার্থীরা ওই সাক্ষাৎকার পর্বটি ভিডিও করবে, অডিও করবে আবার লিখেও রাখবে। দশজন শিক্ষার্থী নিয়ে একেকটি দল গঠন করা হবে। আর এসব দলের নেতৃত্বে থাকবেন একেকজন শিক্ষক। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানগণও এতে আমন্ত্রিত হবেন। প্রতিটি স্কুল থেকে ৩১সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি দলকে বিজয়ী করে উপজেলায় পাঠানো হবে। আগামী ‘বিজয় দিবসে’ সেরা তিনটি দলকে পুরষ্কৃত করা হবে।

লেখকের সাথে বীরমুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব:) তাহের উদ্দীন আখঞ্জি।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রতিটি দলের প্রাপ্ত নম্বর তাদের বার্ষিক পরীক্ষার ধারাবাহিক মূল্যায়ন অংশ হিসেবে যোগ হবে। দীর্ঘদিন পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জানা বুঝার সুযোগ পেলাম। খুব কাছ থেকে দেখেছি দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি কি অদম্য টান একেকজন মুক্তিযোদ্ধার! হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী এস.সি.উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত আমার দলে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অবঃ) তাহের উদ্দীন আখঞ্জি। যিনি ৫ নং সেক্টরে একজন সাব সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন। শুধু মেজর (অবঃ) তাহেরই নন, ওনার পরিবার থেকে যুদ্ধ করেছেন আরো দুজন। চাচা- আজির উদ্দিন আখঞ্জি এবং ভাই- জালাল উদ্দিন আখঞ্জি। চট্টগ্রামে পুলিশ বিভাগে কর্মরত ভাই জালাল উদ্দিন আখঞ্জি মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন। আমি ও আমার শিক্ষার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি যুদ্ধকালীন সময়ের সেইসব ‘সাহসী গল্প’। অহংকারে বুকটা ফুলে উঠেছে। মনে হয়েছে এ ‘আরেক মুক্তিযুদ্ধ’। আর এ যুদ্ধে আমি ও আমরা একেকজন ‘নবীন যুদ্ধা’। মেজর (অবঃ) তাহের উদ্দিন আখঞ্জি সাহেবের নিজ বাড়ি উপজেলার পুটিজুরী ইউনিয়নের যাদবপুর গ্রামে। ওখানেই সাক্ষাৎকার পর্বটির কাজ চলছিল। ‘মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার’ পর্বে নির্ধারিত ৪১টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে একজন অংশগ্রহণকারীকে। ওইসব প্রশ্নোত্তর পর্বেই উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের আদি-অন্ত। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার ভূমিকা, ৭ই মার্চের ভাষণ, ২৫শে মার্চের কালোরাত, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের কার্যক্রম, পাকিস্তানীদের অত্যাচার, ভারতের সহযোগিতা; কি ছিল না এই প্রশ্নোত্তর পর্বে? পরে ছিল ‘উন্মুক্ত আলোচনা’। আমাদের অতিথির আন্তরিকতার কারনেই হয়ত ছাত্রীরা অবাধে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছিল। একের পর এক প্রশ্ন। গুরুত্বপূর্ণ, শিশুতোষ ও আবেগপূর্ণ এসব প্রশ্নের যেনো শেষ নেই। অথচ ক্লাশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিক্ষার্থীদের এমন আগ্রহ চোখে পরেনি। কি আবেগ তাদের চোখেমুখে! বয়োজ্যেষ্ঠ ওই মুক্তিযোদ্ধাও যেনো তাদেরকে পেয়ে বেশ আপ্লুত! বীরত্ব গাথা অনেক অজানা কথা ওঠে এসেছে তাঁর আলাপচারিতায়। আমার প্রিয় শিক্ষার্থীরা তাদের কচি হাতে ওইসব ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছে। যা হয়ত আগামী প্রজন্মকে অনেক বেশী দায়বদ্ধ করবে। পড়ন্ত বিকেলে যখন শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফিরে আসি, তখন তাদের চোখেমুখে পরিতৃপ্তির হাসি। এ হাসি অহংকারের, এ হাসি গর্বের!

লেখকঃ পংকজ কান্তি গোপ, সহকারি শিক্ষক, পুটিজুরী এস.সি.উচ্চ বিদ্যালয়, বাহুবল, হবিগঞ্জ।

ই-মেইলঃ titubahubal79@gmail.com

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com