বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : গ্রীষ্মের খরতাপ আর বর্ষার অবিরাম বাদল ধারাকে পাশ কাটিয়ে উজ্জ্বল এক আকাশ নিয়ে প্রকৃতিতে আগমন ঘটায় শরৎ। শুভ্রতায় ভরপুর এক ঋতু এটি। আকাশজুড়ে সাদা মেঘের আনাগোনা আর নদীর তীর জুড়ে কাশফুলের দোলা নিয়ে রাজত্ব চালায় শরৎ। বর্ষামেয়ের মনের গহীনে লুকোনো মেঘ গুড়গুড় দুঃখকে সে ঢেকে দেয় স্নিগ্ধতার চাদরে।
ভাদ্র আর আশ্বিন দুই মাস থাকে শরতের আয়ু। আজ ভাদ্রের প্রথম দিন। অর্থাৎ, প্রকৃতি জানান দিচ্ছে শুভ্রতায় মোড়ানো ঋতু শরৎ এসেছে। এ ঋতুর প্রকৃতি মন ছুঁয়েছিল কবি গুরুর। তিনি লিখেছিলেন, ‘আজি কি তোমার মধুর মূরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে! হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে।’
শরতের বৈশিষ্ট্য কী? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে পাওয়া যায় ছন্নছাড়া গুচ্ছ সাদা মেঘের দল, সাহসী সূর্যের শাসানো হাসি, সবুজে ভরপুর ফসলের ক্ষেত আর তুলোর মতো সাদা কাশফুল। মায়াবী শরতের চঞ্চলতার একটি বড় অংশ ঘিরে থাকে রোদ-বৃষ্টি-মেঘের আলোছায়া খেলা। এই তেজ ছড়ানো সূর্যের দাপট আর এই মেঘের শীতল ছায়া—এই দুইয়ের যুগলবন্দিতেই শরতের বিরাজ।
শরতের গল্প বলতে গেলে উঠে আসে স্বর্গের ফুল পারিজাতের কথা। আমরা যাকে শিউলি বলে চিনি আরকি। সফেদ রঙা পাঁচ পাপড়ি আর জাফরান রঙা ডাঁটের এ ফুল শরতকে করে আরও স্নিগ্ধ। সারারাত নিজের সুগন্ধ ছড়িয়ে সকালবেলা ঝরে পড়ে মাটিতে।
জ্যোৎস্নাকে যারা উপভোগ করতে চান তাদের জন্য সেরা ঋতু শরৎ। নিজের সৌন্দর্যের সবটুকু ঢেলে শরতের জোছনা রাঙিয়ে রাখে প্রকৃতি। অন্য সময়ে জোছনার তুলনায় তাই শরতের জোছনা আবেদনময়ী বেশি। জোছনারাতে নদী পাড়ে বসে হালকা বাতাস আর শিউলির ঘ্রাণকে সঙ্গী করে চাঁদের মায়াজালে বন্দি হতে চান অনেকেই।
শরৎ মানে সতেজতা। আর এই সতেজতাকে ঘিরে থাকে নানা ফুল। শরতের ফুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হল কাশফুল আর শিউলি। বালুর চরগুলো হালকা আর লোমশ কাশফুলে ভরে উঠে এসময়। এ যেন প্রকৃতির এক সাদা গালিচা। শরতের রাতে সুগন্ধ বিলায় ছোট্ট ফুল শিউলি। আর সকালে কমলা-সাদা শিউলি ফুলে ভরে যায় শিউলি তলা।
শরতের অন্যান্য ফুলগুলোর মধ্যে রয়েছে- শেফালি, হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ, বকফুল, মিনজিরি, কলিয়েন্ড্রা। কেবল তাই নয়, শরতের রূপের অংশ হয় শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কামিনী, মালতি, মল্লিকা, মাধবী, ছাতিম ফুল, বড়ই ফুল, দোলনচাঁপা, বেলি, জারুল, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, জয়ন্ত্রী, রাধাচূড়া, স্থল পদ্মসহ নানা রকমের ফুল।
ঋতুরাজ বলা হয় বসন্তকে, এ কথা সবাই জানেন। তবে ঋতুরাণীকে হয়ত অনেকেই চেনেন না। শরতকে বলা হয় ঋতুরাণী। আর তাই তাকে ঘিরে কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্য রচনা থাকাটাই স্বাভাবিক। শরতকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন বাংলার বহু কবি। তাদের কবিতার ভাষায় ফুটে উঠেছে শরতের অপরূপ সৌন্দর্য।
‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা..’— জনপ্রিয় এই রবীন্দ্রসঙ্গীতই শরতের রূপ বর্ণনায় যথেষ্ট। কবিগুরুর ভাষায়- ‘তুলি মেঘভার আকাশে তোমার- করেছ সুনীল বরণী/ শিশির ছিটায়ে করেছ শীতল/ তোমার শ্যামল ধরণী।’
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ শরতকে তুলনা করেছেন প্রিয়তমার সঙ্গে। প্রেম-দ্রোহের কবি নজরুলকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল শরতের প্রকৃতি। বিশেষ করে শিউলি ফুলে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। নজরুলের ভাষায়- ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে। / এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে।’
শরৎ এলেই মাঠজুড়ে দেখা দেয় নতুন ধানের সমারোহ। নতুন ফসলের আশা জাগে কৃষকের মনে। আর সেই ফসলকে ঘিরে চারদিকে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। ফুলের সুবাস আর পাখির কুজনে মুখরিত হয় পল্লীগ্রামের মাঠ-ঘাট-জনপদ।
শরৎ মানেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর। শারদীয় দুর্গাপূজার শারদীয় শব্দের আগমনই ঘটেছে শরত থেকে। এই শরতেই দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা কৈলাশ ছেড়ে মর্তে আসেন ভক্তদের কাছে। আর তাই নদীর পাড়ে কাশফুল জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথেই বাতাসে যেন ছড়িয়ে পড়ে- শরৎ এসেছে, পুজো আসছে।
শরতের সঙ্গে তারুণ্যের সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। এ সময়ের পোশাকের নীলের আধিক্যই যেন একটু বেশি চোখে পড়ে। হয়ত তরুণ-তরুণীরা নিজেদের এক খণ্ড আকাশ হিসেবে সাজিয়ে ঘুরে বেড়াতে চায় সাদা কাশফুলের বনে। যুগল থেকে শুরু করে পরিবার, স্বজন, বন্ধু— প্রায় সবাইকেই শরতের এই সময়টাতে নদীর পাড়ে কাশবনগুলোতে ঘুরতে দেখা যায়। তরুণীদের অনেকেই নীল শাড়ি, সাদা কাঁচের চুড়ি আর লাল টিপে বাঙালি রমণী হয়ে উঠে, তরুণের অনেকেই গায়ে জড়ায় নীল পাঞ্জাবী।
স্বচ্ছতা আর শুভ্রতা মেশানো ঋতু শরৎ। এ ঋতুতে যেন সবই রয়েছে কিন্তু কিছুর আধিক্য নেই। শরৎ কমিয়ে দেয় রোদের তেজ, কমিয়ে দেয় বৃষ্টির আসা যাওয়া। হালকা উষ্ণতা আর হালকা হিমেল বাতাসের স্পর্শ ঘিরে থাকে এ ঋতু। আকাশ দেখার ঋতু শরৎ, মেঘের ছুটে চলায় চোখ রাখার ঋতু শরৎ, ঘাসের ওপর ছড়িয়ে পড়া শিউলি কুড়ানোর ঋতু শরৎ।