মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৮ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার হত্যাকারী বা হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন-বিক্ষোভ সমাবেশে করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা৷ হত্যার বিচার দাবিতে মিছিলও করেন তারা। ফুঁসে উঠছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) মধ্যরাতে পুলিশ রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর ৬৮ নম্বর বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে রুম্পার মরদেহ উদ্ধার করে৷ অজ্ঞাত হিসেবে মরদেহটি উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায়৷ সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহটি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে দেয়ার মুহূর্তে রুম্পার পরিবার খবর পায়৷ পরে সেখানে গিয়ে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছ থেকে মরদেহটি এনে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
রুম্পার বাবা রোকন উদ্দিন পুলিশ পরিদর্শক৷ তিনি হবিগঞ্জ সদরের চৌধুরীবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ৷ তিনি বলেন, পরিবার ঢাকায় থাকে৷ আমি থাকি হবিগঞ্জে৷ ওই দিন কী ঘটেছে সেটা আমি বলতে পারবো না৷ তবে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কয়েকটি সরকারি কোয়ার্টার আছে৷ সেখানে অনেক ব্যাচেলর ছেলে থাকে৷ ঘটনার পর থেকে কয়েকজন ছেলে পালিয়ে গেছে, তাদের রুমে তালা দেয়া বলে জেনেছি৷ ধর্ষণের বিষয়টি পুলিশও সন্দেহ করছে৷ তবে এখনও নিশ্চিত নয়৷ কিন্তু এটা যে হত্যাকাণ্ড সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত আমি৷ পুলিশ নিশ্চয়ই তদন্তে মূল অপরাধীদের খুঁজে বের করবে বলে আমি আশা করি৷
রুম্পা মৃত্যুর আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন বলে ধারণা পুলিশের৷ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, মৃত্যুর আগে রুম্পা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কি-না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আলামত সংগ্রহ করে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে৷ রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে৷ সন্দেহ থেকেই তো ভিসেরা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে৷
রুম্পা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন৷ বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাতে সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডে মরদেহটি পাওয়ার পর পুলিশ ধারণা করছিল আশপাশের কোনও ভবন থেকে পড়ে যাওয়াই তার মৃত্যুর কারণ৷ কিন্তু আশপাশের ভবনে খোঁজ নিয়েও ওই তরুণীর পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ৷
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, রুম্পা মালিবাগের শান্তিবাগে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন৷ বুধবার সন্ধ্যার পর রুম্পা বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন৷ সঙ্গে নিজের মোবাইল ফোনটিও নেননি৷ উঁচু থেকে পড়ে শরীরে যে ধরনের জখম হয়, রুম্পার শরীরে সে ধরনের আঘাতের চিহ্ন আমরা পেয়েছি৷ ধারণা করছি, রুম্পাকে সিদ্ধেশ্বরীর কোনও একটি ভবন থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে৷ সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী পুলিশ কর্মকর্তা ধর্ষণের সন্দেহ করেছেন৷
রুম্পার মৃত্যুর বিষয়টি এখনও পুলিশের কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয়৷
রুম্পার পারিবারিক সূত্র জানায়, রুম্পা দু’টি টিউশনি করে বুধবার সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন৷ পরে তিনি কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হন৷ বাসা থেকে নিচে নেমে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, আংটি, ঘড়ি ও স্যান্ডেল বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে এক জোড়া পুরোনো স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে যান৷ কিন্তু রাতে আর বাসায় ফিরেননি৷
স্বজনরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার সন্ধান পাননি৷
বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) স্বজনরা রমনা থানায় গিয়ে মরদেহের ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করেন৷
মোবাইল ফোন, আংটি, ঘড়ি খুলে রেখে বাইরে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে রোকন উদ্দিন বলেন, কয়েকদিন আগে ওর একটি মোবাইল ফোন চুরি হয়েছে৷ তাই আমি ওকে বলেছি, সন্ধ্যার পর বাইরে গেলে এগুলো নিয়ো না৷ সে কারণে রেখে যেতে পারে৷
রুম্পাকে ধর্ষণ এবং হত্যা করা হয়েছে, নাকি তিনি নিজেই আত্মহত্যা করেছেন সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ রুম্পার সহপাঠীদের দাবি, রুম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷
শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) দুপুরে সিদ্ধেশ্বরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাসের ফটকের সামনে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেছেন৷ সেখানে প্ল্যাকার্ডে ‘রুম্পার ধর্ষকদের বিচার চাই’, ‘এরপর কে’, ‘আমি কি নেক্সট’, ‘রুম্পার মতো আর কত মেয়ে, ‘পরবর্তীজন আপনি না তো’—এমন সব স্লোগান লেখা ছিল৷ ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে স্লোগানও দেন তারা৷
শনিবারও বিক্ষোভ, অচল ক্যাম্পাস
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমীন রুম্পার মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে অচল ধানমণ্ডি ও সিদ্ধেশ্বরী স্টাম্পফোর্ড ক্যাম্পাস।
শনিবার (৭ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই শিক্ষার্থী রুম্পার মৃত্যুকে হত্যা দাবি করে ফের ধানমণ্ডি ও সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। ক্লাস ছেড়ে মিছিল বিক্ষোভ ও মানবন্ধনের পাশাপাশি স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে উঠে ক্যাম্পাসের পরিবেশ।
শিক্ষার্থীদের দাবি, রুম্পা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিন্তু ঘটনার তিনদিন পেরিয়ে গেলেও হত্যা রহস্যের কূল-কিনারা করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। এ হত্যার সঙ্গে জড়িত যারা আছে তাদের যেন দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানায় তারা। পাশাপাশি এ আন্দোলন প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান হয়। যেন সকল শিক্ষার্থী ও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
মানববন্ধন শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ধানমণ্ডি ১৯ থেকে ১৫ নম্বর পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ কর্মসূচিতে অংশ নেন।
সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ
রুম্পার মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে ঘটনাস্থলের আশপাশের ৩ ভবনের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছে রমনা থানা পুলিশ। পাশাপাশি রুম্পার প্রেমিক সৈকতকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাকে শর্ত সাপেক্ষে মুচলেকা নিয়ে ছাড়লেও তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। রুম্পার সহপাঠী এবং বন্ধুদের সঙ্গে এ বিষয়ে পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
রুম্পার মৃত্যু হত্যা, না আত্মহত্যা, তা নিশ্চিত হতে ঘটনাস্থলের পাশের ৩টি বহুতল ভবনের বাসিন্দা ও নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশ। তিনটি বাড়ির প্রত্যেক ফ্ল্যাটের সকল কক্ষ এবং বেলকনি ও ছাদ পরিদর্শনও করেছেন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) রাজীব আল মাসুদ দৈনিক জাগরণকে বলেন, রুম্পাকে ভবন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। যদিও এই ঘটনায় কে বা কারা জড়িত সে ব্যাপারে পরিবার ও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে সম্ভাব্য সব দিক গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ফরেনসিক বিভাগের বক্তব্য
রুম্পার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী ড. সোহেল মাহমুদ জানান, নিহত তরুণীর হাত, পা ও কোমরসহ শরীরের কয়েক জায়গায় ভাঙা ছিল। ভবন থেকে পড়ে মারা যাওয়ার আগে তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল কি না তা জানতে আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।
হত্যা মামলা দায়ের
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলের পাশে তিনটি ভবন আছে। এগুলোর কোনও একটি থেকে পড়ে রুম্পা মারা গেছেন। আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে, মামলা তদন্তাধীন। ইনজুরিগুলো দেখে মনে হচ্ছে উঁচু কোনও জায়গা থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে। তার শরীর থেকে আলামত সংগ্রহ করে ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা করেছে।
৬ মাসে ধর্ষণের শিকার ৭৩১ জন নারী
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে ৭৩১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৩ জন৷ তাদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৭৬ জনকে৷ হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ১০ জনকে৷ শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৫৪ জন নারী ও শিশু৷ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৭০ জন৷ আর এ সময়ে মারধরের শিকার হয়েছেন ১৪৭ জন৷ একই সময়ে ২ হাজার ৮৩টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে দেশে৷
নারী নির্যাতনের এই সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে নারী নেত্রী খুশি কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নারী হোন আর যেই হোন, মূল সমস্যা পুরুষতান্ত্রিক মানষিকতা৷ এটা বদলাতে হবে৷ নারী নির্যাতনের বিচার করতে হবে দ্রুত৷ আজ যে পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে মারা গেলেন, সেখানে দেখেন ফেনীতে নুসরাত রাফী থানায় গিয়েও নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ থানাগুলোতে পুলিশের মানসিকতা বদলাতে হবে৷ এই কাজগুলো করা না গেলে দেশে এমন ধষর্ণের ঘটনা কমবে না, বরং দিন দিন বাড়তে থাকবে।