শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩২ অপরাহ্ন
ক্রীড়া ডেস্ক: সাদামাটা লক্ষ্য তাড়ায় শুরুতেই পথ হারাল বাংলাদেশ। বাঁহাতি পেসার ফজল হক ফারুকির বোলিং কাঁপিয়ে দিল টাইগারদের। ১২ ওভারের মধ্যে মাত্র ৪৫ রানে ৬ উইকেট খুইয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল তারা। ব্যাট হাতে অভিজ্ঞদের শূন্য থলির দিনে চরম বিপর্যয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ। দুই তরুণ মিলে সপ্তম উইকেটে গড়লেন রেকর্ড জুটি। তাতে জেঁকে বসা হারের শঙ্কা পেছনে ফেলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ল বাংলাদেশ।
বুধবার তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আফগানিস্তানের ২১৫ রানের জবাবে ৭ বল হাতে রেখে ৪ উইকেটে জিতেছে বাংলাদেশ। এক পর্যায়ে, চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ম্যাচ থেকে প্রায় ছিটকে গিয়েছিল তারা। সেই করুণ অবস্থান থেকে স্বাগতিকদের কক্ষপথে ফিরিয়ে অবিশ্বাস্য এক জয় উপহার দেন আফিফ ও মিরাজ।
২০১৮ সালে মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে সপ্তম উইকেট জুটিতে ১২৭ রান যোগ করেছিলেন ইমরুল কায়েস ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। সেই রেকর্ড এবার ভাঙা পড়েছে। আফিফ ও মিরাজ দুজনেই দুর্দান্ত ফিফটি হাঁকিয়ে খেলেন ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। আফিফ অপরাজিত থাকেন ১১৫ বলে ৯৩ রানে। তিনি মারেন ১১ চার ও ১ ছক্কা। মিরাজ করেন ১২০ বলে অপরাজিত ৮১ রান। তার ব্যাট থেকে আসে ৯ চার।
আফগান লেগ স্পিনার রশিদ খানের করা ইনিংসের ৪৩তম ওভারে ইমরুল ও সাইফউদ্দিনকে টপকে যান আফিফ ও মিরাজ। ওয়ানডেতে সপ্তম উইকেটে ২২৫ বলে তাদের অবিচ্ছিন্ন ১৭৪ রানের জুটিই এখন বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ। অভিজ্ঞদের ব্যর্থতার দিনে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে অনবদ্য এক ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লেখেন তারা। তাদের জুটি পঞ্চাশ পেরিয়ে যায় ৫৮ বলে। এরপর দুজনে হয়ে ওঠেন সাবধানী। জুটির শতরান পূরণ হয় ১৪১ বলে। তাতে টাইগাররা পেয়ে যায় জয়ের ভিত।
অথচ কী মহাবিপর্যয়েই না পড়েছিল বাংলাদেশ! নতুন বলে সুইংয়ের পসরা সাজিয়ে জোড়ায় জোড়ায় উইকেট তুলে নেন ফারুকি। ইনিংসের তৃতীয় ওভারে তার শিকার হন লিটন দাস ও টাইগার অধিনায়ক তামিম ইকবাল। পঞ্চম ওভারে মুশফিকুর রহিম ও অভিষিক্ত ইয়াসির আলীকে ফেরান তিনি। এরপর সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ বাজে শটে ফিরলে একেবারে খাদের কিনারায় পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। সেখান থেকে দলকে টেনে তোলেন আফিফ ও মিরাজ।
শুরুতে আফিফ ছিলেন রানের দিক থেকে বেশ এগিয়ে। তিনি ফিফটি স্পর্শ করেন ৬৪ বলে। মিরাজ ধীরস্থির শুরু করলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে দেখা যায় তাকে। তিনি হাফসেঞ্চুরি ছুঁয়ে ফেলেন ৭৯ বলে। এরপর হাত খোলা শুরু হয় তার। তাতে আফিফের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে থাকেন তিনি।
রীতিমতো নিখুঁত ইনিংস খেলেন আফিফ ও মিরাজ। বাহারি সব শট খেলে দুজনের কেউই থামেননি শেষটা রাঙানোর আগে। তাদেরকে থামাতে পারেননি রশিদ, ফারুকি, মুজিব উর রহমানরা। ম্যাচ জেতানো শটটা আসে বাঁহাতি আফিফের ব্যাট থেকে। নাইবকে তিনি মিড-উইকেট দিয়ে পুল করে চার মারলে জয় নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের।
আফিফ খেলেন চোখ ধাঁধানো সব শট। তার ফ্লিক করে মারা বাউন্ডারিগুলো ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে লেগে থাকবে অনেকদিন। মিরাজও কম যাননি। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে ব্যাট হাতেই সুনাম ছিল তার। বড় মঞ্চে এসে সেই ধারা বজায় রাখতে পারেননি। তবে এই ম্যাচে তিনি দেখান ভাণ্ডারে কত শট রয়েছে তার! লেট-কাটগুলো এক কথায় অদ্ভুত সুন্দর!
মাঝে ফ্লাডলাইট ঠিকঠাকভাবে জ্বলে উঠতে দেরি হওয়ায় প্রায় ১৩ মিনিট বন্ধ ছিল খেলা। কিন্তু আফিফ ও মিরাজের মনঃসংযোগে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। ফের খেলা শুরু হলে তারা চালিয়ে যান আগের মতো কর্তৃত্বের সঙ্গে।
বল হাতেও কারিশমা দেখান ম্যাচসেরা মিরাজ। একটানা করেন ১০ ওভার। উইকেট না পেলেও মাত্র ২৮ রান খরচ করেন তিনি। এর মধ্যে মেডেন ছিল ৩টি। আফগানিস্তানের ব্যাটারদের মোট ৪৩টি ডট বল খেলান তিনি। অর্থাৎ তার আঁটসাঁট লাইন-লেংথের জবাব ছিল না প্রতিপক্ষের।
ফেরা যাক পেছনে। ৩৮.২ ওভার তখন, আফগানিস্তানের সংগ্রহ দাঁড়িয়েছিল ৪ উইকেটে ১৬৫ রান। নাজিবউল্লাহ জাদরান ৪১ আর মোহাম্মদ নবি ২০ রানে খেলছিলেন। তারা গড়ে ফেলেছিলেন ৬২ বলে ৬৩ রানের জুটি। দুজনই থিতু হয়ে যাওয়ায় রান আসছিল অনায়াসে। তাদেরকে চাপে ফেলতে পারছিলেন না সাকিব-শরিফুল ইসলামরা।
বাংলাদেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়ছিল ক্রমেই। কারণ, আফগানদের জন্য তখন প্রস্তুত ঝড় তোলার আদর্শ মঞ্চ। হাতে পর্যাপ্ত উইকেট আর ক্রিজে দুই সেট ব্যাটার থাকায় সেই কাজটা হতে পারত বেশ সহজ। কিন্তু হয়নি। আফগানদের ইনিংসের পুরোটা জুড়ে ঠিক সময়মতো উইকেট তুলে নেওয়াটা ঠিকঠাকভাবে করে টাইগাররা।
ওই ওভারের তৃতীয় ডেলিভারিটি তাসকিন আহমেদ করেন অফ স্টাম্পের বাইরে। সেটা কেড়ে নেয় নবির উইকেট। তার ব্যাট ছুঁয়ে বল জমা পড়ে উইকেটরক্ষক মুশফিকের গ্লাভসে। আফগানিস্তানের বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য ছুঁড়ে দেওয়ার স্বপ্ন জোর ধাক্কা খায় তখন।
মূল আঘাতটা আসে আরও কয়েক ওভার পর। ফিফটি তুলে নেওয়া জাদরানের সঙ্গে মাত্র জমে উঠতে শুরু করেছিল নাইবের জুটি। বাকি সতীর্থদের চেয়ে তুলনামূলক খরুচে সাকিব- যা প্রায় বিরল দৃশ্য- তা দেন ভেঙে। ৪৫তম ওভারে তিন বলের মধ্যে এই বাঁহাতি স্পিনার আউট করেন দুজনকে।
ফ্লাইটে পরাস্ত নাইব এলবিডব্লিউ হওয়ার পর রিভিউ নিয়েছিলেন। পাল্টায়নি মাঠের আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত। এরপর রশিদের উইকেটটি বিনোদিত করে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। ব্যাক-ফুটে খেলতে গিয়ে স্টাম্প হারিয়ে হতভম্ব হয়ে যান তিনি। বিপরীতে, চওড়া এক হাসি খেলে যায় সাকিবের মুখে।
৫ উইকেটে ১৯৪ থেকে মুহূর্তেই ৭ উইকেট খুইয়ে ফেলা আফগানদের ভিত নড়ে যায়। দারুণ নিয়ন্ত্রিত বল করা মোস্তাফিজুর রহমান ও শরিফুল মিলে ছাঁটেন বাকিটা। ৫ বল থাকতেই দলটি গুটিয়ে যায় ২১৫ রানে। তাদের শেষ ৫ উইকেট বাংলাদেশ আদায় করে নেয় কেবল ২১ রান দিয়ে।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা সফরকারীরা ভালো উইকেটে ভালো শুরু পেয়েও প্রত্যাশিতভাবে শেষ করতে পারেনি। আরও সহজ করে বললে, টাইগার বোলাররা ধূলিসাৎ করে দেন আফগানদের চ্যালঞ্জিং স্কোরের সম্ভাবনা।
পুরো ইনিংসে ১৭৫টি ডট বল খেলেছে আফগানিস্তান। জাদরান বাদে কেউই পেরোতে পারেননি পঞ্চাশ। তার ব্যাট থেকে আসে ৮৪ বলে সর্বোচ্চ ৬৭ রান। আরও পাঁচ ব্যাটার দুই অঙ্কে পৌঁছালেও কেউই লম্বা সময় থাকতে পারেননি ক্রিজে।
প্রচুর ডট খেলার মাঝেও রানের চাকা আফগানরা সচল রেখেছিল বাউন্ডারির মাধ্যমে। কয়েক ওভার পরপরই তারা আদায় করে নিচ্ছিল বড় রানের একটি ওভার। তবে তাদের জুটিগুলোকে ডানা মেলতে না দিয়ে বরং সঠিক সময়ে বাক্সবন্দি করে বাংলাদেশ। পরে নাগালে থাকা লক্ষ্য বাইরে যেতে বসলেও আফিফ ও মিরাজের বীরত্বে আসে স্মরণীয় এক জয়।