বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:১৭ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা : বুধবার রাত সাড়ে ১০টা। গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্ফোরন। মূহুর্ত্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন। সেই আগুনে চকবাজারের চুরিহাট্টার সরু গলিতে হাজী ওয়াহেদ ম্যানসন তখন দাউদাউ আগুনে পুড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয় চারদিক, শুরু হয় হাহাজারি। চোখের সামনে এসে পড়তে থাকে একের পর এক লাশ। কিন্তু চামড়া পোড়া চর্বি বেরোনো বিকৃত সেই দেহগুলো যে মানুষের, তখন পর্যন্ত তা বুঝে উঠতেই পারেননি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও। রাত পেরিয়ে যতই দিন গড়াতে থাকে ততই বাড়তে থাকে মানুষের লাশের সংখ্যাও।
এমনিতেই একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাংলাদেশে দেশজুড়ে শোক পালন হচ্ছে। এরওপর ঢাকার চকবাজারে আগুনে পুড়ে বহু মানুষের প্রাণহানীতে পুরো বাংলাদেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। আগুনের ঘটনায় অন্তত ৭০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী। লাশের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি। আগুনে দগ্ধ হয়ে অনেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আগুনে চকবাজার চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশের অন্তত পাঁচটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ভবনে বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি ছিল রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও প্রসাধন সামগ্রীর গুদাম। দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়ায় বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় যারা হাসপাতালে রয়েছেন তাদের চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যারা আহত হয়ে বেঁচে আছেন তাদের চিকিৎসা চলছে। তাদের চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হবে না। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১২ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। কমিটিকে আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধদের দেখতে এসে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
পুরান ঢাকার চকবাজারের আগুনে পোড়া বাড়ির পাশে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কে পড়ে আছে অসংখ্য পারফিউম, এয়ার ফ্রেশনারের কৌটাসহ পলিথিন তৈরির কাঁচামাল। এই দাহ্য পদার্থগুলোর কারণে আগুন বেশি ছড়ায় বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। নয় বছর আগে নিমতলীতে অগ্নিকান্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদামগুলো সরানোর দাবি উঠেছিল জোরেশোরে, কিš‘ তা না হওয়ার মধ্যে চকবাজারের অগ্নিকান্ড ঘটল। নিমতলীর ঘটনা স্মরণ করে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, এটা আমাদের ভালো একটা লেসন দিয়েছে, ওয়েক আপ কল দিয়েছে, তোমরা সতর্ক হও।
বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ৬৭টি ব্যাগে করে লাশ এসেছে । এ ছাড়া আরও তিনটি ব্যাগে লাশের খন্ডিত অংশ আনা হয়। ৭০টি লাশ উদ্ধার করে ব্যাগে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়েছে। কিš‘ এনিয়েও দ্বিমত রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেছেন, তারা ৬৭টি লাশ পেয়েছেন। ময়নাতদন্তের পর শনাক্তকরণের ভিত্তিতে এগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সংখ্যার এই গড়মিলের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক তারেক হাসান ভূইয়া বলেন, আমাদের হিসাবে লাশ ৭০টি। তবে কয়েকটা ব্যাগে খন্ড খন্ড ডেডবডি ছিল। সম্পূর্ণ ডেডবডি হয়ত ৬৭টি হতে পারে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২২ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রিয়জনের লাশের সন্ধানে হাজারো মানুষ ভিড় করছেন মর্গের আশপাশে। কেউ আহাজারি করছেন। স্বজনকে জীবিত অথবা মৃত খুঁজে পেতে কেউবা এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছেন। ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ লাশের পরিচয় মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এ জন্য ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে বলে চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে।
অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১৫ ঘণ্টা পর আগুন নিভিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণার সময় মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, রাসায়নিকের গুদামগুলো সরাতে তারা এখন জোর পদক্ষেপ নেবেন।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, আগুন লাগার পরপরই চার তলা ভবনটির সামনে থাকা বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ ঘটে। ওই সময় রাস্তায় থাকা কয়েকটি গাড়িতেও আগুন ধরে যায়। বাশার নামে হায়দার বক্স লেনের একজন বাসিন্দা বলেন, আগুনের সময় রাজমহল হোটেলের সামনের রাস্তায় কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণের পর ওই গ্যাস সিলিন্ডারেও আগুন লেগে ভবনে ও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভানোর জন্য অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর ১০টি ইউনিট সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে। পরে ইউনিটের সংখ্যা ৩৭টিতে গিয়ে ঠেকে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ জন। এর বাইরে পুলিশ, র্যাবের পাশাপাশি হেলিকপ্টার নিয়ে বিমানবাহিনীও যোগ দেয় আগুন নেভানোর কাজে। পুরান ঢাকার ওই সংকীর্ণ সড়কে ভবনগুলোর ছোট ছোট কক্ষে আগুন জ্বলতে থাকায় তা নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছিল বলে জানান অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ খান। ভোররাতে একবার আগুন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনার পরও আবার তা ছড়িয়ে পড়েছিল।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে আগুন আয়ত্তে আনার কথা জানান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক শাকিল নেওয়াজ। তখন ভবনের ভতরে ঢুকে একের পর এক লাশ বের করে আনছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা, সেখানে একটি তথ্য কেন্দ্র খুলে বোর্ডে সর্বশেষ তথ্যও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।
স্থানীয়রা জানান, চুরিহাট্টা এলাকাটি একটি সরু গলি, যেখানে দুইটি রিকশা কোনোমতে যাতায়াত করতে পারে। আগুনের ঘটনার সময়ে সরু এই গলির হাজী ওয়াহেদ ম্যানসন থেকে শুরু করে পাশের ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, জেলখানা মোড়সহ আশেপাশের সবখানেই ছিল যানজট। আর তাই হঠাৎ যখন আগুনের বিস্ফোরণ ঘটে, তখন ওই যানজটে পড়া মানুষগুলো আর বের হতে পারেননি। আগুনের বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের দেয়ালটি যানজটপূর্ণ এলাকার রাস্তার ওপর ভেঙে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এতে তাৎক্ষণিকভাবেই মারা যান বেশ কজন পথচারী।
এলাকাবাসীরা বলেন, আগুন এমন দানবের মতো হানা দেয় যে হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের উত্তরের রাস্তায় দাঁড়ানো পিকআপ ভ্যান, রিকশা, সাইকেল, মোটর সাইকেল— সব নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যেগুলো এখন বিবর্ণ হয়ে চুরিহাট্টার ওই রাস্তায় পড়ে আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে সবকিছু রাস্তায় লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে আছে। যেন যুদ্ধবিধস্ত কোনো এলাকা বা ধ্বংসস্তূপ। যে আগুন এত প্রাণ, এত সম্পদ কেড়ে নিয়েছে, সেই আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জানতে চাইলে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ বলছেন, ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার কারখান থেকে এর সূত্রপাত, কেউ বলছেন, আগুন লেগেছে ভবনটির পাশের হোটেল থেকে। কেউবা ভবনের উত্তর দিকের রাস্তার গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে এই আগুনের সূত্রপাত বলে জানান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চুরিহাট্টার ৬৪ নন্দ কুমার দত্ত লেনে অবস্থিত হাজী ওয়াহেদ ম্যানসন। ভবনটি চার তলা, এর আন্ডারগ্রাউন্ডে আরও একতলা রয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ডের পুরোটাই গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গুদামটি ক্যামিকেল বোঝাই। চার তলা ভবনটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার পুরোটাই কারখান ও গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব কারখানা ও গুদামে সুগন্ধি, পাউডার (কসমেটিকসসহ কলকারখানার পণ্য), খেলনা, বাতি (ডিমলাইট), ফ্রিজ মেরামত, গ্রিজ-মবিলসহ দাহ্য পদার্থের ব্যাপক কারবার। আর নিচতলাতে বিভিন্ন দোকান ভাড়া দেওয়া আছে।
হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের উল্টো দিকে ৬৩/১ নন্দ কুমার দত্ত লেনের বাসিন্দা মো. খাতিবুর রহমান বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন লাগে। হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত। ওই তলায় অনেক রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ থাকায় মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটে। আগুনের বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের দেয়ালটি যানজটপূর্ণ ব্যস্ত রাস্তার ওপর আছড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভবনটির পশ্চিম-উত্তর কোণে থাকা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারটিতেও বিস্ফোরণ ঘটে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য।