শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৯ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : শনিবার সকালে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মাওলানা সা’দ আহমাদ কান্ধলভী ও মাওলানা যোবায়ের আহমেদ পন্থীরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে একজন নিহত ও পাঁচ শতাধিক মুসল্লি আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক একেএম কাওসার চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সংঘর্ষের মধ্যে ইসমাইল মণ্ডল (৭০) নামে মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
এমন পরিস্থিতির মাঝেই বিকালে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সচিবালয়ে এ বৈঠক হয়। বেলা তিনটায় বৈঠক শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ আসতে দেরি করে। বিকেল পৌনে চারটার দিকে সভাস্থলে আসেন সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, মাওলানা জুবায়ের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দ বিকেল পৌনে পাঁচটায় আসলে বৈঠক শুরু হয়।
এতে দিল্লি মারকাজের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভিপন্থী বাংলাদেশে তাবলিগের শুরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম এবং তাদের বিরোধী মাওলানা জুবায়েরের পক্ষ থেকে মাওলানা আশরাফ আলী, আবদুল কুদ্দুসসহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
দুই পক্ষের বিবাদের কারণে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ইজতেমা পেছানোর সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
বৈঠকে পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, কয়েক মাস আগে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা ভারতীয় মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভীর কিছু বক্তব্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ ছড়িয়ে পড়ে।
সাদ কান্ধলভী বলেছিলেন, ‘ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়।’ কান্ধলভীর ওই বক্তব্যের মধ্যে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ড পড়ে বলে মনে করা হয়।
এছাড়াও সাদ কান্ধলভী বলেছিলেন, মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত- যাতে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে।
কান্ধলভীর এসব বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন তাবলিগের অনেক শীর্ষ নেতা ও তাদের অনুসারীরা।
তাদের দাবি সাদ কান্ধলভী যা বলছে, তা তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের নির্দেশিত পন্থার বিরোধী। কান্ধলভীর কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া’ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।
গত জুলাই মাসে মাসে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতিতে তাবলিগ জামাতের একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে সাদ কান্ধলভীকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তবে শনিবার টঙ্গীতে যে সংঘর্ষ হয়েছে তার সঙ্গে হেফাজতের কোনো লোক জড়িত নয় বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মো. ফয়জুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, এখানে হেফাজত বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এর আগে বিবিসির প্রতিবেদনেও উঠে আসে একই ধরনের তথ্য, ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন এই তাবলীগ জামাতের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে – যখন তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়।
ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়- এ বছর জুলাই মাসে ঢাকায় কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ আহমদ শফী’র উপস্থিতিতে তাবলীগ জামাতের একাংশের এক সম্মেলন হয়। এতে সাদ কান্দালভিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় – দিল্লিতে তাবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাদ কান্দালভির বক্তব্য ও মতবাদকে অনুসরণ করা হবে না, এবং আগামী বিশ্ব ইজতেমার সময় তাকে বাংলাদেশে আসতেও দেয়া হবে না।
তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে তাবলীগ জামাতের দু’টি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের প্রভাব গত ইজতেমাতেও পড়েছিল।
সে সময় এ নিয়ে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে – যখন মি. কান্দালভি বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেও ইজতেমা প্রাঙ্গণে যেতে পারেন নি।
মি. কান্দালভি তার বিরোধী পক্ষের প্রতিবাদের মুখে ঢাকায় তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় কাকরাইল মসজিদ অবস্থান নেন, এবং পরে সেখান থেকেই দিল্লী ফেরত যান।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী এখনো তবলীগ জামাতের প্রধান দফতর কাকরাইল মসজিদেই অবস্থান করছেন, কিন্তু কার্যক্রম চালাচ্ছেন আলাদা আলাদা ভাবে।
মি. কান্দালভির সমর্থক গোষ্ঠীর একজনের মতে, তাবলীগ জামাতের ৯০ শতাংশই ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’ বা সা’দ কান্দালভি-র অনুসারী হিসেবেই আছেন। কিন্তু তার কিছু কথাকে একটি গোষ্ঠী সহজভাবে নিতে পারছেন না।
তার বিরোধীদের পেছনে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের লোকেরা সক্রিয় বলে বলা হলেও – হেফাজতের নেতারা এ অভিযোগ সরাসরি স্বীকার করেন না।
হেফাজতে ইসলামের একজন উর্ধতন নেতা মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ বলেছেন, এখানে হেফাজত বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
এ বিরোধ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের তাবলীগ জামাতের অনুসারীদের মধ্যে। ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বের বিভক্তি দেখা দিয়েছে অনেকদিন আগেই।
তবে, বিরোধ মেটানোর চেষ্টা থাকলেও তাতে এখনো ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।
সূত্র: বিডি২৪লাইভ