মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ অপরাহ্ন
: নূরুল ইসলাম মনি :
২৬ মার্চ। আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে এবার স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে। ফলে দিবসটি প্রায়ই নিরবেরই পালিত হয়েছে। ওইদিন রাতে হঠাৎ সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নজর পড়ল; দেখলাম, মহামারী থেকে মুক্তি জন্য রাত ১০:০০টায় কোন এক সংগঠন সারাদেশে একযোগে আজান কর্মসূচি দিয়েছে। সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে রাত ১০:০০টার পর দেখলাম কোথাও কোথাও আজান হয়েছে। রাত ১১:০০টার পর থেকে আমার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে বিভিন্ন স্থান থেকে কল আসতে থাকলো। কেউ জানতে চাইলেন, অমুক জায়গায় বুঝি এক শিশু সন্তানের জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই সে কথা বলেছে। তার বাবা-মাকে বলেছে, আজান দিতে হবে, যারা আজান দেবে না তারা ২৬ মার্চ রাত ১২টার পর ভূমিধ্বসে তলিয়ে যাবে। কলার আমার কাছে এর সত্যতা জানতে চেয়েছেন। আবার গ্রামের বাসিন্দা কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠে কল দিয়ে বলছেন, ভাই- ভূমিকম্প হবে নাকি; সবাইতো আজান দিচ্ছে। এমন নানা অদ্ভুদ প্রশ্নের জবাবে আমি যাকে যেভাবে পেরেছি বুঝানোর চেষ্টা করেছি। এসবই গুজব, আপনরা ঘরে ফিরে যান।
এরপর খবর আসতে থাকলো, গ্রাম-গঞ্জ-শহরগুলোতে আতঙ্কিত মানুষ ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ বলে মিছিল দিচ্ছেন। কোথাও কোথাও মিছিলে সুরে ঘুম থেকে উঠে নারী-শিশুরাও দৌঁড়াচ্ছে।
রাতের এসব ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনও কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে পড়ে। বাহুবল সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পারভেজ আলম চৌধুরী নিজ উদ্যোগে কাসিমুল উলুম মাদরাসার নায়বে মুহতামিম মাওলানা আজিজুর রহমান মানিক ভাইকে ঘুম থেকে তোলে এনে এ ব্যাপারে মসজিদের মাইকে কিছু বলার অনুরোধ করেন। রাত ১টায় কাসিমুল উলুম মাদরাসা মসজিদের মাইকে মাওলানা আজিজুর রহমান মানিক “মধ্য রাতে মিছিলকারীদের ঘরে ফিরে নিরবে আল্লাহকে ডাকার অনুরোধ জানান।” এরপর থেকে সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দেখলাম, “গুজব রটনাকারীদের কেউ ভৎসনা করছে আবার কেউ আজাদ ও মিছিলের পক্ষে নানা যুক্তি ও দলিল-দস্তাবেজ দেখাচ্ছেন।”
আমি অসময়ে আজান দেওয়া, মিছিল দেওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করার যোগ্য নই। তবে একটি কথা বলতে চাই। গুজব রটনাকারীকে ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইন সমর্থন করে না। যারা বলছেন, “একটি শিশু জন্মের পরই কথা বলেছে এবং জানিয়েছে আজান না দিলে ভূমিধ্বসে তলিয়ে যেতে হবে”। তারা কী কাজটি ভাল করছেন? তারা কি একবারও ভেবেছেন, বিশ্ববাসী করোনা ভাইরাসের হু হু বিস্তারে বিপর্যস্ত আতঙ্কিত। এ অবস্থায় পূর্ব ঘোষণা ব্যতিরেখে অসময়ে আজান, মধ্যরাতে মিছিল কিংবা ভূমিধ্বস-ভূমিকম্পের গুজব শুনে সদ্য গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠা আতঙ্কিত মানুষগুলোর কি অবস্থা পারে?
মনে রাখতে হবে, এমন গুজবে বার বার বিভ্রান্ত হতে হতে এক সময় মানুষ সত্যটাকে বিশ্বাস করবে না। তখন শতর্কীকরণ (ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস সহ বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকা) তথ্যও মানুষ বিশ্বাস করবে না। একটি বহুল প্রচারিত গল্প দিয়ে শেষ করতে চাই-
“এক ছিল রাখাল বালক। বনের ধারে সে গরু চরাত। একদিন সে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঘ এসেছে বাঘ।’ গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করতে ছুটে এল, হাতে লাঠিসোঁটা, দা-কুড়াল। এসে দেখল, রাখাল বালক হাঁসছে। বাঘ আসলে আসেনি। সে মজা করছিল।
কয়েক দিন পর আবারও সে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঘ, বাঘ।’ সহজ-সরল গ্রামবাসী। একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসে। তারা আবারও দৌঁড়ে এল; বনের ধারে এসে দেখল রাখাল বালক হাঁসছে।
তারা আবারও ‘ডজ’ খেয়ে ফিরে গেল যার যার কাজে।
মাস খানেক পরে আবারও চিৎকার করে উঠল সেই রাখাল বালক। ‘বাঘ এসেছে বাঘ’।
গ্রামবাসী আবারও ছুটে এল রাখাল বালককে উদ্ধারে। এসে দেখল, রাখাল বালক হাঁসছে। তোমাদের কী রকম ঠকালাম। আসলে বাঘ আসেনি।
তারপর একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এল। রাখাল বালক তার স্বরে প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল, বাঘ এসেছে বাঘ।
গ্রামবাসী কেউই আর এগিয়ে এল না। কতবার আর ঠকা যায়। শেষ পর্যন্ত বাঘ খেয়ে ফেলল রাখাল বালকটিকে।”
লেখক : সাংবাদিক।