বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪২ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : গল্পটা ঠিক সিনেমার মতো। মধ্যরাত। তার উপর করোনাকাল। পুরো (মৌলভীবাজার) জেলা লকডাউন। শ্রীমঙ্গল শহরের রাস্তাঘাট গাড়িশূন্য, চারদিক সুনসান। প্রসূতি এক নারীর প্রসবযন্ত্রণা আর ফুঁপানো ক্রন্দন সহ্য করতে পারছে না চারপাশের প্রকৃতিও। পাওয়া যাচ্ছে না অ্যাম্বুলেন্স, সিগন্যাল দিলে থামছে না কোনো গাড়ি । জীবনযুদ্ধের এক সংকটাপন্ন মুহুর্তে দু’টো প্রাণ।
এই অবস্থায় কী করবেন পরিবারের সদস্যরা? ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে কল দেয়া হলো তাঁকে। বললেন- ‘মাত্র দুইটা মিনিট অপেক্ষা করুন, আসছি।’
দুই মিনিট এক সেকেন্ড হয়নি, নিজের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই চলে আসলেন তিনি। এসেই সরকারি গাড়িতে তুলে নিলেন নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখাতে যুদ্ধরত এক ‘মা’-কে। ভিউগলের আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে হাসপাতালের দিকে ছুটে চললো তাঁর গাড়ি ।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখলেন নিচে ট্রলি নেই। খবর পাঠিয়ে ট্রলি আনতে ব্যয় হবে মূল্যবান কয়েকটি মিনিট। কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে নিজের কোলে তুলে নিলেন সন্তানকে সুন্দর ধরণীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যাকুল ওই ‘মা’-কে। সিড়ি ভেঙে একে একে উঠলেন তৃতীয় তলায়, হন্তদন্ত হয়ে প্রসূতি নারীকে নিয়ে ঢুকে গেলেন অপারেশন থিয়েটারে। দায়িত্ব শেষ, এবার ফেরার পালা।
উচ্চতার দাঁড়িপাল্লাকে পরাজিত করা অপার মানবতার এক অনুপম দৃশ্য দু’চোখ ভরে অবলোকন করলেন হসপিটালের কর্তব্যরত চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। সবার চোখে-মুখ থেকে প্রষ্ফুটিত তখন করোনাকালের এই মহানায়কের তরে শ্রদ্ধা আর প্রার্থনামিশ্রিত অনুচ্চারিত প্রশংসাকাব্য। কিন্তু সত্যিকারের সেই নায়ক প্রশংসাপূর্ণ সকল বড় বড় চোখকে পেছনে ফেলে দৃঢ় পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন হসপিটাল ছেড়ে, হয়তো আর কোনো বিপদগ্রস্ত প্রাণের ডাকে সাড়া দিতে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৯ এর শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি মো. আনোয়ার হোসেন শামীম। এই গল্পের নায়ক তিনিই। রবিবার (২৬ এপ্রিল) রাতে বিপদে পড়া প্রসূতি এক নারী এবং তার নাড়িছেঁড়া সন্তানকে বাঁচাতে অতুলনীয় মানবতার স্বাক্ষর রেখে এভাবেই সাহায্য করলেন র্যাব অফিসার শামীম আনোয়ার।
জানা গেছে, রবিবার (২৬ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১১টার দিকে লকডাউন পরিস্থিতিতে শ্রীমঙ্গলে এক প্রসূতি নারীর প্রসবযন্ত্রণা শুরু হয়ে শরীরের অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যানবাহন সংকটে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। তখর ওই নারীর বোনের ছেলে নির্মল পাল র্যাব-৯ এর শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি মো. আনোয়ার হোসেন শামীমের মোবাইল নাম্বারে কল দিয়ে সবকিছু খুলে বলেন। খবর পাওয়া মাত্র আনোয়ার শামীম দুই মিনিটেই ওই নারীর বাসায় পৌঁছে যান এবং তাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যান। শুধু হসপিটালে পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজে কোলে করে ওই নারীকে হসপিটালের ৩ তলায় অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছে দেন।
নির্মল পাল আনোয়ার শামীমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেন, ‘শামীম স্যারকে ভগবান যেন অনেক বড় পুরস্কার দেন। রবিবার রাত সাড়ে এগারটার দিকে আমার পিসির প্রসব বেদনা ওঠে এবং একসময় রক্তক্ষরণ শুরু হয়। কিন্তু বাচ্চা প্রসব হচ্ছিলো না। তাই হসপিটালে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু ওই সময় চারদিকে খুঁজাখুজি করে কোনো গাড়ি পাওয়া যায়নি। দুশ্চিন্তায় সবাই অস্থির। এমন সময় এক বড় ভাই শামিম স্যারের নাম্বার দিয়ে বললেন- উনাকে কল দিয়ে বিস্তারিত বলো। তিনি সব বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করেন। কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে কল দিলাম। কিন্তু তিনি আমার সকল সংশয় দূর করে ঠিক ২ মিনিটের মাথায় নিজে এসে আমার পিসিকে হসপিটালে নিয়ে গেলেন। ওই রাতে উনার সাহায্য না পেলে হয়তো আমার পিসি আর নবজাতক ভাইকে বাঁচানো সম্ভব হতো না।’
নির্মল জানান, তার পিসির গর্ভ থেকে ছেলেসন্তানের জন্ম হয়েছে। মা ও ছেলে দুইজনই বর্তমানে সুস্থ আছেন।
এএসপি মো. আনোয়ার হোসেন শামীম এ বিষয়ে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেসবুকে লেখেন, ‘আমি তখন রাত্রিকালীন টহল ডিউটিতে। ফোন পেয়ে সেখানে পৌঁছে দেখি প্রসূতি মা-টি খুব সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে আছেন। ব্লিডিং হচ্ছে, বেদনাও প্রচণ্ড, কিন্তু বাচ্চা প্রসব হচ্ছে না। গাড়িতে তুলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। নিচতলা থেকে কোলে করে তিনতলার প্রসূতি ওয়ার্ড পর্যন্ত নিতে নিতে পুরো ইউনিফর্ম রক্তে ভিজে গিয়েছিলো, তবুও আমি খুশি। যাদের ট্যাক্সের টাকায় দু’মুঠো ডালভাত খাই, তাদের প্রয়োজনের মুহূর্তে রেসপন্স তো করতে পেরেছি।’
এদিকে, র্যাব অফিসার শামীম আনোয়ারের এমন মহৎ কাজের ভিডিও এবং স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দুই দিন থেকে ভাইরাল। ঘুরছে একজন থেকে আরেকজনের ওয়ালে, আর বর্ষিত হচ্ছে কেবল প্রশংসা আর দোয়ার ফুলঝুরি।