বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৯ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : বাংলা একাডেমির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আর নেই।
বৃহস্পতিবার (১৪ মে) বিকাল ৪ টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে…রাজিউন)।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়ছিল ৮৩ বছর।
জাতীয় অধ্যাপকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ২৭ এপ্রিল হৃৎরোগ সমস্যার পাশাপাশি কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতা, পারকিনসন্স, প্রোস্টেটের সমস্যা ও রক্তে সংক্রমণের সমস্যা নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের চিফ কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক খন্দকার কামরুল ইসলামের অধীনে করোনারি কেয়ার ইউনিটে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এরপর গত শনিবার অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এর আগে ফুসফুসের সংক্রমণসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তারও আগে দেশের বাইরে গিয়ে কয়েকবার চিকিৎসা নেন তিনি।
মুক্তচিন্তা ও বাঙালি চেতনার সর্বজনগ্রাহী এই সারথি ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাটের মা-বাবার কোল আলোকিত করে জন্ম নেন ক্ষণজন্মা এই বাঙালি ব্যক্তিত্ব।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন সময়ের এক আধুনিক মানুষ। তার হাতে প্রাণ পেয়েছে এ দেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতিটি স্তর। জ্ঞানের চর্চায় আলোকিত করে গেছেন আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রকে। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিকাশকে দিয়েছেন গতি। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। সেখানে থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাংলা ভাষা ও শিক্ষার অনন্য প্রভাব সঞ্চারী এ মানুষটির ১৯৫০ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার প্রপিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন ১৯ শতকের প্রতিষ্ঠিত গদ্যকার।
একাত্তরে তাজউদ্দীনের বিচক্ষণ কর্মকাণ্ড খুব কাছ থেকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রসঙ্গীত উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ড. আনিসুজ্জামান।
তার হাতে বাংলা গদ্যের প্রমিত এবং উৎকর্ষমণ্ডিত আদর্শ রূপের একটি মানদণ্ড দাঁড়িয়েছে। পিএইচডি গবেষণার অভিসন্দর্ভ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’কে বাঙালি মুসলমান সমাজের সাহিত্য-মানস মূল্যায়নে প্রথম প্রয়াস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ড. আনিসুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করেছেন প্রাক্-উনিশ শতকি বাংলা গদ্যের নিদর্শন। তার ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ একটি অসামান্য গবেষণা গ্রন্থ।
মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লিখেছেন ‘আমার একাত্তর’ বইটি।
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পুনর্গঠন, বাংলা সাময়িকপত্রের গবেষণা ও বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপসন্ধানী রচনার মধ্য দিয়ে জাতিকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পুরো নাম আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। বাবা আবু তাহের মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন। সুগৃহিণী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল তার মায়ের। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তার বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। শিক্ষা-দীক্ষা ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্য ছিল তাদের পরিবারের।
বাংলা একাডেমি বৃত্তি পান আনিসুজ্জামান। তবে এ বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে অ্যাডহক ভিত্তিতে যোগ দেন।
১৯৬৯ সালে আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। পরে ভারতে গিয়ে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। সেখান থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক পদে সম্মানিত করে।
তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।
তার রচিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থ এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।তার প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’, ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’, আমার একাত্তর, ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর’, ‘আমার চোখে’, ‘বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে’, ‘পূর্বগামী’, ‘কাল নিরবধি’, ‘বিপুলা পৃথিবী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তিনি বেশকিছু উল্লেখযোগ্য বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদও করেছেন। সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন গ্রন্থ।
শিক্ষা ক্ষেত্রে, শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আনিসুজ্জামান একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার, দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক , অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি. লিট সম্মাননা।
তার উল্লেখযোগ্য স্মারক বক্তৃতার মধ্যে রয়েছে- এশিয়াটিক সোসাইটিতে (কলকাতা) ইন্দিরা গান্ধী স্মারক বক্তৃতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎচন্দ্র স্মারক বক্তৃতা, নেতাজী ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সে নেতাজী স্মারক বক্তৃতা এবং অনুষ্টুপের উদ্যোগে সমর সেন স্মারক বক্তৃতা।