মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:৩১ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : মাত্র ৫৪ বছরের জীবন; তার মধ্যে এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ১২ বছরের বেশি কেটেছে কারাপ্রকোষ্ঠে। দিনের হিসেবে চার হাজার ৬৮২ দিন।
বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীনতা বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম কারাবরণ সেই ছাত্রজীবনে, তখন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের দিন।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বইপত্র, প্রবন্ধ এবং নানা নথিপত্র ঘেঁটে তার কারাবাসের দিনগুলো সম্পর্কে জানা গেলেও ঠিক কতদিন তিনি জেলে ছিলেন সে বিষয়ে কোনো নথিতেই সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই।
তবে বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের রাজনৈতিক সচিব, আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ ২০১৭ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, ৫৪ বছর বয়সের জীবনে বঙ্গবন্ধু চার হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন।
এর মধ্যে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাতদিন কারাভোগ করেন বঙ্গবন্ধু, বাকি চার হাজার ৬৭৫ দিন তার জেলে কাটে পাকিস্তান আমলে।
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, কারাগারে থাকার কারণে তার ছোট ভাই-বোনরা বাবার সংস্পর্শ খুব কমই পেয়েছিলেন।
ভাই শেখ কামালের একটি ঘটনা জানাতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “শেখ কামাল আব্বাকে কখনো দেখে নাই, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি, ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে…ও হঠাৎ আমায় জিজ্ঞেস করল, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলে ডাকি।”
প্রথম জেলজীবন: ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জে সহপাঠী বন্ধু আবদুল মালেককে হিন্দু মহাসভার সভাপতির বাড়ি নিয়ে মারপিট করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সেই বাড়িতে গিয়ে ধাওয়া করেন, এসময় সেখানে হাতাহাতিও ঘটে। এরপর গ্রেপ্তার হয়ে সাতদিন জেল খাটেন মুজিব। পরে মুরুব্বিদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মিটমাট হলে মামলা থেকে রেহাই পান তিনি।
১৯৪১: অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলার সহ-সভাপতি থাকাকালে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে এবং সভাস্থলে গোলযোগের মধ্যে অবস্থান করায় দুইবার সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৮: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের এক নম্বর গেটের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। পাঁচদিন কারাবাসের পর ১৫ মার্চ মুক্তি পান। পাকিস্তান শাসনামলে এটাই তার প্রথম গ্রেপ্তার।
১৯৪৮-৪৯: ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান তিনি। এ দফায় ১৩২ দিন কারাগারে কাটাতে হয় তাকে।
১৯৪৯: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালনের সময় ১৯ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন, ২৮ জুন মুক্তির আগে ৮০ দিন জেল খাটেন। এরপর ৩১ ডিসেম্বর আবারও গ্রেপ্তার হন তিনি।
১৯৫০-৫২: ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৫০ ও ১৯৫১ সাল তার কারাগারেই কাটে। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পান। এই দফায় টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন।
১৯৫৪: ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিলের পর গ্রেপ্তার হন মুজিব, ২০৬ দিন কারাভোগ করেন তিনি।
১৯৫৯: ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় ১৪ মাস জেল খেটে বের হলে আবারও তাকে জেলগেটে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুক্তি পান তিনি।
১৯৬২: ৬ ফেব্রুয়ারি জননিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ১৮ জুন জেল থেকে মুক্তি পান তিনি।
১৯৬৪-১৯৬৮: ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে গ্রেপ্তার হন। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের টাউন হল ময়দানে জনসভা শেষে ধানমণ্ডির বাসায় ফেরার পর দেশরক্ষা আইনে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। সেই সময় তিনি প্রায় তিন বছর কারাবন্দি ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি জেল থেকে ছাড় পেলেও ওইদিন জেলগেট থেকে ফের গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এরপর তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়।
১৯৬৯: গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান। কারামুক্তির পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তাকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়।
১৯৭১-৭২: ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তিনদিন পর তাকে পাকিস্তান নিয়ে লায়ালপুর জেলে (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) বন্দি করে রাখে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
[আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, কাজী সিরাজুল ইসলাম এবং মো. জাহিদ হোসেন সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ, প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার’ গ্রন্থ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।]