বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০২ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাস। মাত্র দুই মাস আগে ভারত ভাগ হয়েছে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়ে দুটি দেশের জন্ম হয়েছে—ভারত ও পাকিস্তান। দেশ দুটির নিজস্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক বিষয়গুলো তখনো পরিপূর্ণ কাঠামো হিসেবেই গড়ে ওঠেনি। এরই মধ্যে সদ্য বিভক্ত দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। কারণ কী? উত্তর, কাশ্মীর।
কাশ্মীর নিয়ে সেই যে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ঝগড়া শুরু হলো, এখনো তা চলছে। ১৯৬৫ সালে ফের এই ইস্যুতেই যুদ্ধে জড়ায় দুটি দেশ। এরপর সময়ভেদে বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান। ভারত সব সময়ই পাকিস্তানের দিকে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তানও বরাবরই অস্বীকার করেছে।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ১৪ ফেব্রুয়ারি এক আত্মঘাতী হামলায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর ৪০ জনের বেশি সদস্য নিহত হন। এতে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। শুরু হয়ে যায় কথার লড়াই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের দিকে অভিযোগ তুলে বলে দেন, এই হামলার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। সেই দাঁতভাঙা জবাবই আজকে এসেছে। সোমবার দিবাগত ভোররাতে দুই দেশের নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অব কন্ট্রোল) ভারতের বিমানবাহিনীর হামলায় ৩০০ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারত। দেশটির দাবি, পাকিস্তানের জইশ-ই-মুহাম্মদ, হিজবুল্লাহ মুজাহেদিন ও লস্কর-ই-তাইয়েবার স্থাপনায় এ বিমান হামলা চালানো হয়।
পাকিস্তানও হামলার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেছে। একই সঙ্গে এ ঘটনার ‘জবাব’ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাকিস্তানের দাবি, হামলা চালানো হয়েছে দেশটির বালাকোটে। পাকিস্তানের বিমানবাহিনী দ্রুত ও কার্যকর সাড়া দেওয়ায় ভারতীয় বিমানবাহিনী পিছু হটেছে।
অবশ্য ‘পিছু হটার’ কথা স্বীকার করছে না ভারত। কিন্তু আদতেই কি ভারতীয় হামলার ‘সামরিক জবাব’ দেবে পাকিস্তান? এই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে কি শেষ পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হবে?
গালফ নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় হামলার জবাবে তাৎক্ষণিক সামরিক হামলা এখন করতে চাইছে না পাকিস্তান। আজ মঙ্গলবার দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জঙ্গি আস্তানা ধ্বংসের যে দাবি ভারত তুলেছে, বৈঠকে তা এককথায় নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। এনএসসি বলছে, ভারত এলওসি লঙ্ঘনের যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তা বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করবে পাকিস্তান। পাকিস্তান ‘ভারতের দায়িত্বজ্ঞানহীন নীতি’ সম্পর্কে বিশ্বকে জানাতে চায়। এক বিবৃতিতে এনএসসি বলেছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিস্যা হিসেবে এই হামলা করা হয়েছে। নির্বাচনী হাওয়া নিজেদের দিকে নিতেই মোদি সরকার এমন কাজ করেছে।
ভারত সরকারের দাবি যে মিথ্যা, তা প্রমাণ করতে বালাকোটের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলও বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে প্রস্তুত আছে পাকিস্তান। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান বলছে, দেশি ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে বালাকোটে নেওয়া হবে এবং হামলাস্থল দেখানো হবে। একই সঙ্গে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হবে।
বিবিসি বলছে, লাইন অব কন্ট্রোল থেকে পাকিস্তানের ৫০ মাইল ভেতরে বালাকোটের অবস্থান। বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানের সীমানার ভেতরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এর আগে এই দুই দেশের মধ্যে যতবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো থেকে সর্বশেষ দুটি ঘটনা একেবারেই আলাদা। ২০১৬ সালে যখন মোদি সরকার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানোর দাবি করেছিল, সেটিও হয়েছিল পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে। এবার কয়েক ধাপ এগিয়ে সরাসরি বিমান আক্রমণও চালাল ভারত। একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে এ ধরনের হামলা একটি বড়সড় হুমকি।
দিল্লিভিত্তিক সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক খালিদ শাহ দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে চলা উত্তেজক পরিস্থিতিতে এই হামলা পুরো ঘটনার গতিপথ পাল্টে দিতে পারে।’
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোশাররফ জাইদি মনে করেন, ভারতের বিমানবাহিনীর চালানো হামলা পাকিস্তানের জন্য একটি ‘বিপর্যয়’। তিনি বলেন, ‘কৌশলগতভাবে, এটি পাকিস্তানকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। কারণ এখন ভারত এ ধরনের একাধিক হামলা চালাতে পারে। এখন ভারত যদি বারংবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায় বা আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে থাকে, তখন পাকিস্তান কী করবে?’ তাঁর মতে, আজকের ঘটনায় পাকিস্তান ধৈর্যের পরীক্ষায় পড়ে গেছে। মোশাররফ জাইদির ভাষায়, কোন সীমা পর্যন্ত পাকিস্তান সহ্য করবে—এটিই পরীক্ষা।
বিমানবাহিনীর সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ১২টি মিরেজ ২০০০ জেট বিমান এ হামলায় অংশ নেয় এবং ১ হাজার কেজি বোমা বর্ষণ করে অনেক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিজয় কেশব গোখলে বলেছেন, ‘এই হামলা একটি ‘বেসামরিক’ পদক্ষেপ এবং শত্রুর হামলা ঠেকাতে তা নেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে জইশ-ই-মুহাম্মদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিমান হামলা কী করে ‘বেসামরিক’ হয়? সিবিএস নিউজের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বা সামরিক ঘাঁটি যে হামলার লক্ষ্যবস্তু নয়, এটি বোঝাতে ভারত মরিয়া। সম্ভবত এ কারণেই সোমবার ভোররাতের অভিযানের এমন সংজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। ভারত হয়তো বলতে চাইছে, শুধু জঙ্গিরাই তাদের লক্ষ্য, পাকিস্তানের সামরিক সম্পদ নয়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট অনলাইনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টিও (বিজেপি) কিছুটা বেকায়দায় ছিল। তবে বিমান হামলার ঘটনার পর ফের সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে মোদি ও তাঁর দল। এখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতীয়তাবাদের ট্রাম্প কার্ড ব্যবহারের সুবিধা পাবেন তাঁরা। একই সঙ্গে বিরোধীদের কোণঠাসা করতে পুলওয়ামার আত্মঘাতী হামলার ‘শোধ’ নেওয়ার কৃতিত্বও দাবি করতে পারবেন।
ওদিকে পাকিস্তানের সিনেটর ও সাবেক রাষ্ট্রদূত শেরি রহমান গার্ডিয়ানকে বলে দিয়েছেন, নির্বাচনকে উপলক্ষ হিসেবে নিয়েই নরেন্দ্র মোদি এমন হামলায় অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই হামলার মধ্য দিয়ে ভারত তার জনগণকে একটি বার্তা দিয়েছে: এটি তাদের নির্বাচনের জন্য, ভোটারদের জন্য।’
এ তো গেল দলীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। কিন্তু এই যে যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ, তার কী হবে?
নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারত-পাকিস্তানের পুরো মাত্রার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। দুটি দেশই আদতে এটি চায় না। কারণ ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং তাদের মধ্যকার পরিপূর্ণ যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলোও ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চায় না। মার্কিনরা এরই মধ্যে দুই পক্ষকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
পাকিস্তানের গবেষক সংস্থা জিন্নাহ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক জাহিদ হুসেইন বলছেন, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ভারতের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। সুতরাং ভারতের পক্ষে যে কোনো বিপজ্জনক নীতি গ্রহণ করা এবং পরিস্থিতি চূড়ান্ত খারাপ হওয়ার আগ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাওয়া সহজ। কিন্তু এ ধরনের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। তখন কিন্তু আর পিছু হটার উপায় রইবে না।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বর্তমান পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, নাকি ভালোর দিকে যাবে—সেই উত্তর জানতে অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।