রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৬ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : হাওর বললেই যেমন বিস্তৃর্ণ জলরাশির ছবি চোখে ভেসে ওঠে, তেমনি ভেসে ওঠে বঞ্চিত এক জনপদের ছবিও। প্রকৃতিও প্রয়াশই বঞ্চনা করে করে হাওরবাসীকে। আগেভাগেই বন্যা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান। বছরজুড়ে আড়ালে থাকলেও অকাল বন্যার সময়ে আলোচনায় ওঠে আসে হাওরের জনপদ।
তবে এবার প্রকৃতি সহায় ছিলো হাওরবাসীর। কয়েকদিন শিলাবৃষ্টিতে আতঙ্ক ছড়ালেও শেষ পর্যন্ত আগাম বন্যা আসেনি। ফলে এবার হাওরজুড়ে হাসছে বোরো ধান। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ধান কাটা। প্রকৃতির এই আনুকল্য আরও সপ্তাহ দুয়েক অব্যাহত থাকলে এবার হাওরে বোরোর বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষক আর কৃষি বিভাগ।
ধান ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ভয় কেটেছে। তবে এবার হাওরে দেখা দিয়েছে ভিন্ন সঙ্কট। ধান কাটার মৌসুমে তীব্র শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শ্রমিকের অভাবে বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটা এখনও শুরু করতে পারেননি কৃষরকরা। শ্রমিক সঙ্কট মোকাবেলায় ১৫ দিনের জন্য জেলার সব বালু ও পাথর মহালের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। আগামী ৫ মে পর্যন্ত এই নির্দেশনা বলবৎ থাকবে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ বছর সুনামগঞ্জে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৩৫ হেক্টর জমি। তবে চাষাবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে। এ বছর জেলায় ২ লাখ ২৪ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। এবার পুরো জেলা প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকেও বালু ও পাথর কোয়ারির শ্রমিকদের ধান কাটার কাজে সহায়তা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরে ৫৫৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)-এর মাধ্যমে জেলার ছোটবড়ো ৩৭টি হাওড়ে ৪৫০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো বাঁধে ফাটলের খবর পাওয়া যায়নি।
সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরঘুরে দেখা যায়, হাওরজুড়ে খেলা করছে সোনালী ধান। কৃষকরা ব্যস্ত ধান কাটায়। হাওড়ে হাওড়ে ধান কাটার ধুম পড়েছে। ফসল ভালো হওয়ায় একে দিন একেক উপজেলায় ‘ধান কাটা উৎসব’ আয়োজন করছে জেলা প্রশাসন। প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা এসব উৎসবে হাজির হয়ে কৃষকদের ধান কাটায় উৎসাহ জোগাচ্ছেন।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরের কৃষক শরিফ উদ্দিন বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ধানের খুব ভালো ফলন হয়েছে। এই সপ্তাহ থেকে ধান কাটাও শুরু করেছি। তবে শ্রমিক সঙ্কটের কারণে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের কৃষক রিয়াজ মিয়া বলেন, ২০১৭ সালে বন্যায় সব ধান তলিয়ে গিয়েছিলো। গতবছরও আশানুরুপ ধান হয়নি। এবার অনেকদিন পর ভালো ফলন হয়েছে। হাওড়ের দিকে তাকালেই মন ভালো হয়ে যায়।
বৃষ্টি না আসলে আগামী ১০/১২ দিনের মধ্যেই ধান কাটা শেষ করা সম্ভব। কিন্তু শ্রমিক না পাওয়ার ফলে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। হাওড়ে এখন তীব্র শ্রমিক সঙ্কট চলছে।
জানা যায়, বজ্রপাত আতঙ্ক, ধান কাটার পর পরিবহনে সমস্যা, কম মুজুরিসহ নানা কারণে ধান কাটার সময় হাওড়ে শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এছাড়া হাওরে সারাবছর কাজ না থাকা ও গত কয়েকবছর ধান না হওয়ায় এই এলাকার শ্রমিকরা অন্যত্র কাজে চলে গেছেন। ফলে এবার শ্রমিক সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের লাউড়েরগড় গ্রামের শ্রমিক সর্দার আমির হোসেন বলেন, ধান কাটার ৩০ জন শ্রমিক এনে দিতে দুই জন কৃষকের সাথে বায়না করেছিলাম। কিন্তু মাত্র ১৭ জন শ্রমিক যোগাড় করতে পেরেছি। তিনি বলেন, পাথর কোয়ারি ও বালুমহালে মজুরি বেশি থাকায় গ্রামের বেশিরভাগ শ্রমিক সেখানে কাজ করতে যায়। তাই ধান কাটার শ্রমিক সংকট।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তর, সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের উপ পরিচালক বশির আহম্মেদ সরকার বলেন, হাওড়ের আবহাওয়া এখনো পর্যন্ত ভালো। এবার ফলনও হয়েছে ভালো। আরও ১৫-২০ দিন সময় পাওয়া গেলে কৃষকেরা তাদের ধান নির্বিঘেœ গোলায় তুলতে পারবেন।
তিনি বলেন, চৈত্রের শেষদিকে ও বৈশাখের শুরুতে কয়েকদিনের শিলাবৃষ্টিতে ধানের কিছু ক্ষতি হয়েছে। তবে তা খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। কৃষকদের ধান কাটায় উৎসাহিত করতে জেলাজুড়ে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ বলেন, শ্রমিক সঙ্কট মোকাবেলায় আমরা ইতোমধ্যে প্রত্যেকটি উপজেলায় বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছি। সব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের আমরা বলেছি তাদের উপজেলাগুলোতে যত বালু, পাথর কোয়ারি রয়েছে সেগুলো বন্ধ রাখার। কৃষদেরও দ্রুত কাটার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া এবার হাওরের বাঁধ নির্মাণে যাতে কোনো গাফিলতি না হয় সেদিকেও আমরা তীক্ষ নজর রেখেছিলাম। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর প্রকৃতির আনুকুল্যে আশা করছি এবার সুনামগঞ্জে বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।