বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৮ অপরাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ও চাল ক্রয়ে চলছে চরম অনিয়ম। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করা হচ্ছে ক্রয়। এতে করে কৃষক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষক ধানের দাম পাওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কৃষকের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগামী বাজেটে কৃষি খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষিখাত সংশ্লিষ্টরা। ওদিকে ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বরদাশত করা হবে না বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
সূত্র জানায়, ধানের দরপতন ঠেকাতে ২৬শে এপ্রিল থেকে সরকারিভাবে ধান-চাল কেনা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু শুরু হয় গত সপ্তাহে। চলবে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এবার বোরো মৌসুমে সাড়ে ১২ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু অভিযানের শুরু থেকেই প্রভাবশালীদের কবজায় চলে যায় ধান সংগ্রহ অভিযান। নেতা ধরেও কৃষক সরকারি গুদামে ধান দিতে পারছেন না। শুধু সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতারাই ধান সরবরাহ করতে পারছেন। ধান বেচার স্লিপও থাকছে তাদের হাতে। ওই সব নেতা রাতারাতি হয়ে উঠেছেন কৃষক। তারা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে সরকারি গুদামে বেশি দামে বিক্রি করছেন। তাই সরকারের ধান কেনায় কৃষক নয়, নেতারাই বেশি লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই মনে করেন, ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালা পরিবর্তন না হলে সরকারের এ সহায়তা কৃষকের কাছে পৌঁছাবে না।
জানা গেছে, বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। নেতারাও কৃষকদের কাছ থেকে ওই দামে ধান কিনছেন। সেই ধান সরকারি গুদামে সরবরাহ করে তারা প্রতি মণে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ধান-বাণিজ্য ও ধানের স্লিপ বিক্রির টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কোন্দল ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চাপে তাদের কাছ থেকে ধান নিতে তারা বাধ্য হন। এদিকে ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বরদাশত করা হবে না বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, প্রশাসনকে কড়াভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা যায়। বুধবার নওগাঁ সদর উপজেলা স্থানীয় খাদ্য সরবরাহ গুদামে (এলএসডি) বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারিভাবে প্রতি কেজি ধানের মূল্য ২৬ টাকা বেধে দেয়া হয়েছে। কৃষক যাতে ধানের প্রকৃত মূল্য পান সেই জন্য আজ থেকে ২০ দিন আগে জেলায় জেলায় সরকারিভাবে ধান-চাল ক্রয়ের বরাদ্দ ভাগ করে দেয়া হয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই ধান ক্রয় কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘ধানসহ কৃষিপণ্যের মূল্য: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বক্তারা বলেন, কৃষকের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগামী বাজেটে কৃষি খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকারিভাবে শস্য গুদাম ২১ লাখ টন থেকে ৬০ লাখ টনে বাড়ানোর আহ্বানও জানান তারা।
খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, কৃষককে রাজনীতিতে এসে তাদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। তিনি বলেন, যারা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় ধান কিনে নেয় তাদের আইন দিয়ে উৎখাত করা যাবে না। আমরা বর্তমানে ভুল অর্থনীতিতে চলছি। বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি অমান্য করে চলছি। প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান বলেন, চাল আমদানিতে শুল্ক বাড়ালে বা কমালেই লাভ হবে না। কারণ আমাদের স্টোরেজ নেই। ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকার তা গৃহস্থের ঘরেই রাখতে পারে। কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সদিচ্ছার প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এই বোরোর কারণে সামনের বোরোতেও প্রভাব পড়তে পারে। তাই এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ২৫ শতাংশ ধান সরকার সংগ্রহ করে। অথচ আমাদের দেশে সংগ্রহ করা হয় মাত্র ৫ শতাংশ। এই মুহূর্তে বলা যেতে পারে যেসব মিলার সরকারকে চাল দেবে তাদের ৩০ মে’র মধ্যে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করতে হবে। তাহলেই বাজারে ধানের দাম বাড়বে।
বিভিন্ন এলাকার কৃষক জানান, তারা ধান নিয়ে খাদ্যগুদামে গেলে ধানে চিটা ও পরিস্কার না, ধানে আর্দ্রতা কমবেশি, গুদাম খালি নেই-এমন অজুহাত দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ প্রকাশ্যে নেতাদের স্লিপে ভেজা ধান নেয়া হচ্ছে। অনেক এলাকায় নেতারা কৃষকের কৃষি কার্ডও রেখে দিচ্ছেন। সেই কার্ড দিয়েই তারা সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করছেন। ওই সব প্রভাবশালী নেতা ভুয়া নামেও সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করছেন। আর চালকল মালিকরা আমদানি করা পুরনো নিম্নমানের চাল সরকারি গুদামে দিচ্ছেন।
মধুপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলায় অনেকটা গোপনে বোরো ধান কেনা হচ্ছে। মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমা আহম্মেদ পলি ট্রেনিং এর জন্য দেশের বাহিরে থাকায় অনেকটা চুপিসারে ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা সিদ্দিকা গত ২১শে মে মধুপুরে ধান ক্রয়ের উদ্বোধন করেন। খাদ্য অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে মধুপুর উপজেলা থেকে ৩৮৪ টন বোরো ধান ক্রয়ের কথা। গত কয়েকদিনে প্রায় সাড়ে ১৮ টন বোরো ধান ক্রয় করা হয়েছে।
মহিষমারা ইউপি চেয়ারম্যান কাজী আব্দুল মোতালেব জানান, রাজনৈতিক নেতারাও কিন্তু কৃষক। তারাও শতশত মন ধান উৎপাদন করেন। নেতাদের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে কথাটা ঢালাওভাবে বলা ঠিক না। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, কৃষি বিভাগ থেকে প্রকৃত কৃষকদের তালিকা দিয়েছি। ধান কেনার দায়িত্ব খাদ্য বিভাগের।
মধুপুরের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা সিদ্দিকা মুঠোফোনে জানান, গোপনে নয়, উপজেলা চেয়ারম্যান ও অন্যন্য অফিসারদের সাথে নিয়ে ধান ক্রয়ের উদ্বোধন করা হয়েছে।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনায় ধান ও চাল ক্রয়ের নামে চরম অনিয়ম ও কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিবিহীন সিন্ডিকেট দিয়ে তা ক্রয় হচ্ছে মর্মে খাদ্য মন্ত্রণালয় বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে অভিযোগ প্রদান করেন জেলা কৃষক লীগের সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার। গত ১৫ই মে তিনি এ অভিযোগটি দেন। অভিযোগে বলা হয়, জেলায় অতীতের ন্যায় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অসাধু কর্মকতার যোগসাজশে একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট চাল মালিক সমিতির কতিপয় লোক কৃষক সংগঠনের নামে ভুয়া প্রতিনিধি বানিয়ে ক্রয় কমিটিতে সদস্য করেছে। এছাড়া কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিবিহীন ভুয়া চাল মিল তালিকা প্রস্তুত করেছে। বিগত পাঁচ বছর অভিযোগ করা সত্বেও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
এ বছর এক বিঘা বোরো জমি চাষ করতে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। ধান উৎপাদন হয়েছে প্রতি বিঘায় ১৫ মণের মতো। হাটে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ধরে ধান বিক্রি করতে পারছেন কৃষক। প্রতি বিঘায় কৃষকের লোকসান সাড়ে ৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া একজন কৃষি শ্রমিকের পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিদিন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে।