রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন
বাহুবলবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায়ী অফিসার ইনচার্জ মাসুক আলী’র ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরলাম
কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ বাহুবল বাসীর নিকট। অফিসার ইনচার্জ হিসেবে বাহুবল মডেল থানায় দীর্ঘ প্রায় ২১ মাস বাহুবল বাসীর সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাহুবল মডেল থানায় যোগদানের পূর্বে সুন্দ্রাটিকি গ্রামে দেশব্যাপী বহুল আলোচিত ৪ (চার) শিশু হত্যা মামলা, আব্দাকামাল গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট সাজিদুর রহমান টেনু হত্যা, মুখকান্দি গ্রামে সংঘর্ষে একই দিনে ডাবল মার্ডার, মহিষদুলং গ্রামে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মোজাম্মেল হক হত্যা, মিরপুর বাজারে দুই গ্রামের দাঙ্গায় সুজন মিয়ার হত্যাসহ ধারাবাহিক ঘটনার পর এক আতংকের জনপদ হিসেবে প্রকাশ পায় বাহুবল। গোষ্ঠীগত দাঙ্গা, তুচ্ছ কারনে দুই গ্রামের দাঙ্গা, জলমহাল দখল নিয়া লাঠি, ফিকল, টেটার ঝনঝনানি, পঞ্চায়েতের মুরুব্বীদের জটিল মারপ্যাচের শিকলে আবদ্ধ অসহায় মানুষের বেদনা, আগের রাতে মিটিং করে সকাল বেলা শত শত মানুষের দেশীয় অস্ত্র নিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারির হুলি খেলার দৃশ্যপটে অশান্ত ছিল বাহুবল। এমনি পরিস্থিতিতে মাননীয় ডিআইজি স্যার ও পুলিশ সুপার স্যারদ্বয়ের নির্দেশনায় বাহুবল মডেল থানায় যোগদান করে কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় দাঙ্গা দমনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি।
দাঙ্গা নিবারণে জনপ্রতিনিধি, কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য এবং সমাজের অসহায় শান্তিপ্রিয় মানুষের অকুন্ঠ সমর্থনে নতুন বার্তা “দাঙ্গায় শান্তি নাই, দাঙ্গাবাজদের রেহাই নাই” পৌছে দেওয়ার চেষ্টা করি। থানার সকল অফিসার ফোর্সদের এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে সাধারন জনগনদের নিয়ে দাঙ্গা দমনের পথ এগিয়ে চলা অব্যাহত রাখি। দাঙ্গা নিবারণে সকল শ্রেণী পেশার লোকদের নিয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। তৎকালীণ পুলিশ সুপার জনাব বিধান ত্রিপুরা, পিপিএম-বার স্যারের দাঙ্গা দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি পুরো হবিগঞ্জ জেলায় ব্যাপক নাড়া দেয়। পরবর্তীতে পুলিশ সুপার জনাব মোহাম্মদ উল্ল্যা, বিপিএম, পিপিএম স্যারের দাঙ্গা দমনে আইনি ব্যবস্থাসহ জনসচেনতামূলক ব্যাপক কার্যক্রম পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। মাননীয় ডিআইজি স্যার এবং মাননীয় অতিরিক্ত ডিআইজি স্যার, সিলেট দ্বয়ের নির্দেশনায় কমিউনিটি পুলিশিংয়ের পাশাপাশি সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং কার্যক্রম দাঙ্গা দমন ও অন্যান্য অপরাধ দমনে সফলতা লাভ করে।
সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার, বাহুবল সার্কেল জনাব পারভেজ আলম চৌধুরীর দিক নির্দেশনা ও মাঠে নেতৃত্ব দিয়ে দাঙ্গা দমনে বাহুবল মডেল থানাকে সাহস যুগিয়েছেন। সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মোঃ জসিম উদ্দিন মহোদয়ের সহযোগীতা পথ চলাকে সুগম করেছে। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব মোঃ আব্দুল হাই মারামারির সংবাদ পেয়ে পুলিশের সাথে সমান তালে ছুটে চলায় জনগনের মধ্যে শান্তি সঞ্চার করেছে। সম্মানিত সাংবাদিক ভাইদের দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে স্বোচ্ছার লেখনি জনগনকে সচেতন করেছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে (গরুর ধান খাওয়া, ছোট বাচ্ছাদের ঝগড়া, দোকানের চায়ের বিল নিয়ে দ্বন্ধ, রাস্তায় চলার পথে কথা কাটাকাটির জের ধরে গোষ্ঠীগত আধিপত্য, জলমহালের দখল নিয়ে দ্বন্ধ, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পূর্ব বিরোধ) ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে মারামারি করার জন্য আগের রাতে মিটিংয়ের খবর গোপনে তথ্য পেয়ে তাৎক্ষনিকভাবে থানার অফিসার ফোর্সদের নিয়ে রাতেই বিবাদমান গোষ্ঠী প্রধানের বাড়ীতে হানা দিয়ে গ্রেফতার, দেশীয় মারাত্মক অস্ত্র, ফিকল, সূঁচালো টেটা, সুলফি উদ্ধারের জন্য সকাল পর্যন্ত ঘরে ঘলর ঝটিকা অভিযান ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধারের ফলে সকালে দাঙ্গার সকল পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়। আতংকিত নিরীহ গ্রামবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট পুলিশকে অন্তর থেকে দোয়া দেয়। গ্রেফতারকৃত উভয় পক্ষের দাঙ্গাবাজদের থানার চৌদ্দ শিকের ভিতরে আবদ্ধ করে রাখার ফলে মানষিকভাবে চরম দূর্বল হয়ে পড়ে। মোবাইল কোর্ট নয়তো মামলা দিয়ে একেকটি লেগুনা গাড়ীতে দাঙ্গাবাজদের ঠাসাঠাসি করে বসিয়ে কোর্টের মাধ্যমে ধুলিয়াখাল লাল দেওয়ালের ভিতরে জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়ার ফলে দাঙ্গাবাজের দাপট ক্রমান্বয়ে চুরমার হতে থাকে। দাঙ্গাবাজদের অবৈধ শক্তির বিনাশে গ্রামের সাধারন মানুষের চোঁখেমুখে প্রশান্তির হাঁসি ফোটে। কখনো বা দুই পক্ষের মারামারিতে জখম হয়ে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য যাওয়া উশৃঙ্খল দাঙ্গাবাজদের হাসপাতালে পুলিশ উপস্থিত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে থানায় নিয়া আসার ফলে দাঙ্গাবাজদের কপালে আতংকের অমানিশার ছাপ পড়ে।
কখনো বা দাঙ্গাবাজদের হাতে থাকা টেটা, ফিকলের সামনে জীবনের ঝুকি নিয়ে আমরা পুলিশ সদস্যরা মারামারি বন্ধের আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছি। উভয় পক্ষের ইটের টুকরোর ঢিলে অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে, গুরুতর ব্যথা পেয়েছে তবুও রাগ করেনি, সহ্য করেছে। দুই পক্ষকে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেইনি। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে রাবার বুলেটের ফাঁকা গুলি, গ্যাসগানের ছোড়া টিয়ারসেলের ধোয়ায় আশ্চন্ন হয়ে দাঙ্গাবাজরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে দাঙ্গাবাজদের নামে পুলিশ এসল্ট মামলা দিলে আসামীরা পুলিশী অভিযানের ফলে ও গ্রেফতারের ভয়ে রাত্রীযাপন করেছে খোলা আকাশের নিচে হাওরে। বাড়ী ছেড়ে রাতের পর রাত জেগে দিশেহারা হয়ে বাধ্য হয়েছে কোর্টে আত্মসমর্পণ করতে। স্নানঘাটের বড় বড় জলমহাল নিয়ে প্রতিবছর দাঙ্গায় প্রাণহানির যে আতংক থাকতো, পুলিশের ব্যকিক্রমী এ্যাকশন চলমান থাকায় স্নানঘাটের কোন মায়ের কোল খালি হয়নি। যেখানেই দাঙ্গা মারামারির সংবাদ, সেখানেই ক্রমাগত পুলিশের পদচারণা ও শক্ত হাতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ায় এবং সর্বস্তরের মানুষ এই কার্যক্রমকে অকুন্ঠ সমর্থন দেওয়ায় দাঙ্গাবাজরা পুরনো ধ্যান-ধারনা, জেদি মনোভাব, শক্তির মহড়া থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয় এবং ক্রমান্বয়ে দাঙ্গা হ্রাস পেতে থাকে। অতীতে দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে যে বাহুবল অশান্ত হয়ে উঠেছিল, সকলের প্রচেষ্টায় সেই বাহুবল শান্তির পথে হাঁটছে। এই পথ যেন অটুট থাকে।
ঐতিহ্যবাহী বাহুবলে আল্লাহর বিশেষ দান খনিজ সম্পদ রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড, প্রাতৃতিক সৌন্দর্যের গাছগাছালি ও পাহাড়, খাসিয়াপুঞ্জি, চাঁ বাগান, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্টান, ধর্মীয় উপাসনালয়, বাহুবলের কোল ঘেষে যাওয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক আর আধুনিক বৈচিত্রময় ‘দি প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট’ বাহুবলকে অনন্য যাত্রায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। দাঙ্গার বদলে শান্তির পথে হাঁটছে।
থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে নয়, জনগনরে সেবক হিসেবে আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি, হয়তো পুরোপুরি সফল হইনি। সহযোগীতা পেয়েছি সকলের। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সকল পেশাজীবি ব্যক্তিবর্গের। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গত ০৩/০৭/২০১৯খ্রিঃ তারিখ আমাকে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় অফিসার ইনচার্জ হিসেবে বদলীর আদেশ প্রদান করিলে আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ মোতাবেক নতুন কর্মস্থলে যোগদানের প্রস্তুতি নেই। গত ০৪/০৭/২০১৯খ্রিঃ তারিখ সন্ধ্যায় আমার প্রিয় কর্মস্থল বাহুবল মডেল থানা কর্তৃক আয়োজিত বিদায় সংবর্ধনা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পুলিশ জনগনের সেতুবন্ধনে পরিনত হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব পারভেজ আলম চৌধুরী, সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার, বাহুবল সার্কেল। অনুষ্টানে বাহুবলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকবৃন্দসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সকলেই বাহুবলের দাঙ্গা দমনে পুলিশের ভূমিকার উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন এবং কার্যক্রম অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেন। সম্মানের সাথে বিদায় দিয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে ইহাই বড় পাওয়া। কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করলেন বাহুবলবাসী। এই বাহুবল এগিয়ে যাক শিক্ষা, শান্তি ও ভালোবাসায়। যাবার বেলায় কৃতজ্ঞচিত্তে কবিতার ভাষায়-
হে মহাসুন্দর শেষ,
হে বিদায় অনিমেষ,
হে সৌম্য বিষাদ
ক্ষণেক দাড়াও স্থির,
মুছায়ে নয়ননীর
করো আশির্বাদ।