সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ০৩:৩৮ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
বাহুবল সানশাইন ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বাহুবল নিউ ভিশন কেজি এন্ড মডেল হাই স্কুলে চাকুরির বিজ্ঞপ্তি পাগলা কুকুরের তান্ডব, শিশু কিশোর যুবক যুবতিসহ আহত ২০ কুয়েত, বাহরাইন, আমিরাতের আকাশপথ আবার সচল যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মধ্যেই ইসরায়েলে ইরানের ‘ক্ষেপণাস্ত্র বৃষ্টি’, নিহত ৩ ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সব ফ্লাইট বাতিল, আকাশসীমা বন্ধ চার দেশের বাহুবলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মাঝে ফ্রী চিকিৎসা সেবা দিলেন ডাঃ শারমিন আক্তার বাহুবলে অপহরণ করে কিশোরীকে রাতভর ধর্ষণ : শালা-দুলাভাই গ্রেফতার গভীর রাতে টিলাধসে একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু শেখ হাসিনার বিচার ট্রাইবুনাল থেকে সরাসরি সম্প্রচার হবে রবিবার

গ্রাম হবে শহর, না নাগরিক সুবিধা যাবে গ্রামে?

আনিসুল হক : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-তে একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার আছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘আমার গ্রাম–আমার শহর’: প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগরসুবিধা সম্প্রসারণ: আমরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করব। শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেব। আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। পাকা সড়কের মাধ্যমে সকল গ্রামকে জেলা-উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। সুপেয় পানি এবং উন্নত মানের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। কর্মসংস্থানের জন্য জেলা-উপজেলায় কলকারখানা গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে যাবে।

এই অঙ্গীকারের মধ্যে ইতিবাচক উপাদান আছে। সবচেয়ে ইতিবাচক হলো, উন্নয়নচিন্তার মধ্যে গ্রামকে স্থান দেওয়া। নাগরিক আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক অধিকার গ্রামেও নিশ্চিত করা। একটা কথা বা স্লোগান নিয়ে দুর্ভাবনাও আছে, ‘আমরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করব।’ গ্রাম হবে শহর—এটা শুনে অনেক নাগরিকই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বেন।

অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে “গ্রাম হবে শহর” স্লোগানটি যথাযথ হবে না বলে মনে করি। কারণ, তাতে দেশের ভূপ্রাকৃতিক বিন্যাস ও নৈসর্গিক বৈচিত্র্য বিনষ্ট হবে। তাই গ্রামের স্বকীয়তা বজায় রেখে শহরের সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রামেই যাতে পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। নদীনালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-তালাব যেমন রাখতে হবে; তেমনি গাছপালা, বনবাদাড়, তরু, লতাগুল্ম, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, খেতখামার, বনবীথি—সব রেখেই পরিবেশবান্ধব আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে হবে। তা না হলে গ্রামকে শহর করার নামে বৃক্ষনিধন, নদী ভরাট আর খালবিল ভর্তি করার মহোৎসব লেগে যাবে। বাংলাদেশ হয়ে পড়বে রুক্ষ, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যহীন, মরুভূমির প্রতিম অন্য এক বাংলাদেশ।’

গ্রামীণ পরিবেশ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী শহর গড়ার কথা আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই বলতে চায়নি। তারা হয়তো বোঝাতে চেয়েছে, আধুনিক নাগরিক সব সুবিধা এবং অধিকার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যাবে; শহরের মানুষ যে সুবিধা পায়, তা থেকে গ্রামের মানুষও বঞ্চিত হবে না। স্লোগানটা শুনলে কিন্তু শহরের নেতিবাচক চিত্রকল্পগুলোই সবার আগে মনে পড়ে। প্রতিটা উন্নয়নের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে; আর অদূরদর্শী উন্নয়নের প্রথম বলি হয় পরিবেশ।

আমাদের গ্রামগুলো যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এই দুঃখ আমাদের পীড়িত করে। শহরের কলুষগুলো, ফেনসিডিল-ইয়াবা থেকে শুরু করে পর্নোগ্রাফি চলে যাচ্ছে গ্রামে, গ্রামগুলো নির্মলতা হারাচ্ছে। গ্রামগুলোর দূষণমুক্ত পরিবেশ-প্রতিবেশ, সিম্পল লিভিং বিগ থিংকিংয়ের ঐতিহ্য কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে অনেকেই এখন ভাবিত। তাদের ‘গ্রাম হবে শহর’ স্লোগানটি দুর্ভাবনায় ফেলে দেয় বৈকি।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সজল চৌধুরী ১১ জানুয়ারি প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘প্রশ্ন হলো, গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা, নাকি গ্রামকে শহর করার পরিকল্পনা? কোনটি সঠিক? যদি প্রথমটি হয়, তাহলে একে সাধুবাদ জানানো যায় অবশ্যই।’ আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণারও বছরখানেক আগে সজল চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘গ্রামগুলো যেন শহরে পরিণত না হয়।’ তিনি ১১ জানুয়ারি আরও লিখেছেন, ‘প্রথমেই প্রয়োজন ইকো ভিলেজ কিংবা স্মার্ট ভিলেজ কনসেপ্ট স্থাপন, যা করতে হবে গ্রাম্য পরিকল্পনার প্রতিটি পর্যায়ে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অভিজ্ঞ গবেষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান—পড়ে থাকা গ্রামগুলোকে নিয়ে ভাবার ও প্রায়োগিক গবেষণা করার। প্রতিটি গ্রামে একটি সমন্বিত কর্ম কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বৃহৎ পরিকল্পনার চেয়ে ক্ষুদ্র ও স্বল্প সময়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দ্রুত বাস্তবায়নই হবে সব থেকে বেশি কার্যকর। এমনকি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদ-নদী, গভীর-অগভীর জলাধার সংরক্ষণ নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, এগুলো রক্ষা করতে না পারলে গ্রামগুলোকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তাহলেই হয়তো গ্রামগুলো তার নিজস্ব স্বরূপ সঙ্গে নিয়ে শহর না বানিয়েও সামনের দিকে চলতে পারবে, নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে গ্রামগুলোতে। দূষণযুক্ত শহরে না এসে গ্রামেই নতুন চিন্তা নিয়ে বসবাস করবে সাধারণ মানুষ।’

আমি একবার নিউইয়র্কে এক সেমিনারে উপস্থিত ছিলাম। তাতে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম। তাঁর লেখা বই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও বাংলাদেশের গ্রাম নিয়ে ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু নতুন প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনা এ রকম—প্রতি গ্রামে যৌথ চাষ হবে এবং ফসলের ভাগ যাবে মালিক, শ্রমিক, গ্রাম তহবিল—এ তিন জায়গায়। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। গ্রামগুলোও এতিম হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর সমবায় গ্রাম হয়নি, জিয়াউর রহমানের গ্রাম সরকারও ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে গ্রাম পরিষদ। এতে গড়ে উঠবে গ্রামের ভেতর থেকেই তহবিল গঠনের সংস্কৃতি।’

২০১৭ সালে একই বই নিয়ে নিউইয়র্কে এক আলোচনায় নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে বিদ্যমান স্থানীয় সরকার কাঠামোগুলোর মতো যদি গ্রামপর্যায়েও গ্রাম পরিষদ নামে আরেকটি স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তোলা হয়, সেটা বিত্তবানদের দখলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা অন্য কাঠামোগুলোর তুলনায় কম থাকবে। কারণ, এটা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান হবে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকে, তাতে সাধারণ মানুষের অভিগম্যতা কম থাকে। সাধারণ মানুষের শক্তি হচ্ছে তার সংখ্যা আর এলিট শ্রেণি বা বিত্তবানদের শক্তি হচ্ছে অর্থ। আর অর্থ বেশি বলে তাদের পেশিশক্তি বেশি। গ্রাম পরিষদ নাগালের মধ্যে বলে সাধারণ মানুষের সংখ্যার শক্তি প্রকাশের সুযোগ থাকে। যার ফলে এই প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রামের কৃষক, খেতমজুর, ভূমিহীনসহ দরিদ্র মানুষের উপকার হবে। তাই স্থানীয় সরকার কাঠামোগুলোর মধ্যে গ্রাম পরিষদ হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বেশি উপকৃত হবে।’

বঙ্গবন্ধু সব সময়েই গ্রাম এবং গরিব–দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলতেন। বাংলা আমার আমি বাংলার (১৯৯৮) নামের বঙ্গবন্ধুর উক্তি সংকলন সম্পাদনা করেছেন শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ। সেই বইয়ের ভূমিকায় লেখকদ্বয় লিখেছেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র স্বপ্ন ছিল বাংলার মানুষকে ঘিরে। বড় গরিব এ দেশের মানুষ। দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস পরনের এক টুকরা কাপড়ই জোটে না। ভেজা কাপড় গায়ে শুকাতে হয়…এই ভাষাহীন মানুষগুলোর কথা ভেবেছিলেন একজন। তিনি বলতে পেরেছেন, “আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি, নৌকায় ঘুরেছি, সাইকেলে ঘুরেছি, পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি, আমি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সমস্যার সঙ্গে জড়িত আছি, আমি সব খবর রাখি।”’

শেখ হাসিনাও ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমার শৈশবের স্বপ্নরঙিন দিনগুলো কেটেছে গ্রামবাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝির ডাক শুনে…।’ তিনি লিখেছেন, ‘গ্রামকে তো আমি শৈশবের গ্রামের মতো করেই ফিরে পেতে চাই।’ ‘গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে কিছু কথা’ প্রবন্ধে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘গ্রামকেই করতে হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু’।

তাঁর এই কথাটাই হতে পারে আদর্শ স্লোগান। ‘গ্রাম হবে শহর’ না বলে ‘গ্রামই প্রাণ’ বা ‘গ্রামই কেন্দ্রবিন্দু’ বা ‘শহরের সব সুবিধা যাবে গ্রামে’—এ ধরনের কথা বলা যেতেই পারে।

আনিসুল হক, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com