বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২২ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক: গ্রামাঞ্চলের সব নাগরিকের সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করতে জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। ফলে নাগরিকদের সুবিধা নিশ্চিতে সবার দায়িত্ব বেড়ে গেছে।
মঙ্গলবার সকালে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সকাল ১০টার পর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দুই বছর বন্ধ ছিল ডিসিদের বার্ষিক সম্মেলন। কোভিড-১৯-এর নতুন ঢেউয়ের কারণে এই সম্মেলন এবার পাঁচদিন থেকে কমিয়ে তিন দিন করা হয়েছে। অন্যান্য বছর জেলা প্রশাসকদের নিয়ে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে এ সম্মেলন হলেও করোনার কারণে এবার জেলা প্রশাসক সম্মেলনের ভেন্যু হয়েছে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী জানান, আওয়ামী লীগের কারণেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে পেরেছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পেরেছে।
এসময় জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, উন্নয়শীল দেশে মর্যাদা পাওয়ায় দায়িত্ব বেড়ে গেছে। উন্নয়নের জন্য জেলাভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের সব নাগরিকের সুবিধা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসকদের নজর দিতে হবে। মানুষ যেন সরকারি সেবা পায় সে বিষয়ে আপনাদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জেলা প্রশাসকদের একটি বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে চাই যে আপনারা কাজ করেন মাঠ পর্যায়ে। প্রতিটি জেলার দায়িত্ব আপনাদের। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং তাদের স্বাবলম্বী করার জন্য আমরা যে ব্যাপক পল্লী উন্নয়নের কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, সেগুলোকে আমরা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আমাদের তৃণমূলের মানুষের জীবনমানের উন্নতি করতে হবে। সেখানেই আমাদের সবচেয়ে বেশি উন্নতি করতে হবে। সেটাই আমি সবসময় বিশ্বাস করি। আমরা ইতিমধ্যে ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড থেকে গ্রাম পর্যায়ের যোগাযোগের জন্য রাস্তা থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করে দিচ্ছি। সেটা আরও ব্যাপকভাবে হবে।
মানুষের কল্যাণে সব ধরনের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করার জন্য জেলা প্রশাসকদের প্রতি অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করাসহ জেলা প্রশাসকদের প্রতি ২৪ দফা নির্দেশনা দেন তিনি।
নির্দেশনাগুলো হলো-
(১) করোনা ভাইরাসজনিত সংকট মোকাবিলায় সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে জারিকৃত নির্দেশনাসমূহ মাঠপর্যায়ে প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে।
(২) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহীত উন্নয়ন ও সেবামূলক কার্যক্রমসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।
(৩) খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
(৪) সরকারি অফিসসমূহে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘ্নে যথাযথ সেবা পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সেবাপ্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত।
(৫) এসডিজি স্থানীয়করণের আওতায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
(৬) গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তসহ সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
(৭) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থায় অনলাইনে বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠদান কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
(৮) কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো যেন কার্যকর থাকে তা প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান করতে হবে এবং নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।
(৯) শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীলতার চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
(১০) নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
(১১) পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে সংগতি রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে। (১২) জনসাধারণের মাঝে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধে উদ্যোগ নিতে হবে।
(১৩) বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
(১৪) মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। মাদকবিরোধী অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে।
(১৫) নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ রোধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে।
(১৬) বাজারে পণ্যের সরবরাহ মসৃণ রাখতে, কৃত্রিম সংকট রোধ ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
(১৭) সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে; পরিকল্পিত নগরায়ন ও বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
(১৮) পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে।
(১৯) জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যসমূহের প্রচার ও বিপণনে উদ্যোগী হতে হবে।
(২০) জেলার সকল সরকারি দপ্তরের কার্যক্রমসমূহ যথাযথভাবে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে আপনাদের ব্রতী হতে হবে।
(২১) জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে কি-না বা বাস্তবায়নও যথযাথভাবে হচ্ছে কি-না সেগুলো সমন্বয় করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প যত্রতত্র যেন না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
(২২) সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি বেদে, জেলে, কৃষক, হিজড়া (ট্রান্সজেন্ডার) ও হরিজন ও পরিচ্ছন্নকর্মীসহ যারা একেবারে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি তাদের সার্বিক উন্নয়ন, তাদের বাসস্থান এবং তাদের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।
(২৩) মুক্তিযুদ্ধের যেসব অঞ্চলে গণহত্যার শিকার পরিবারদের বর্তমান অবস্থা জানা ও তাদের যথাযথ সম্মানজনক জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
(২৪) গণকবর সংরক্ষণ ও যেসব যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতিহাস জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাত্র ১৫টি মন্ত্রণালয়ের ১৫ জন মন্ত্রী ও সচিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সন্ধ্যায় ভার্চুয়ালি ভাষণ দেবেন এবং বুধবার জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও প্রধান বিচারপতির ভার্চুয়ালি ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে।
কোভিড-১৯, ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইন প্রয়োগ, স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য হ্রাস ও কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কার্যক্রম, আইসিটি ও ই-গভর্নেন্স, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, ভৌত অবকাঠামো এবং সম্মেলনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।