শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫২ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক: আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও এরশাদ, মিছবাউর রহমান ও বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জোটগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রায় চূড়ান্ত। রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে জোট সম্প্রসারণের ঘোষণা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ।
বর্তমানে দেশে ৪০টি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন থাকলেও ১২৯টি দল নিয়ে ‘ঐতিহাসিক’ জোট গড়তে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এসব দলের ক্ষমতাসীনদের জোটে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। এর বাইরে আরও অন্তত ২০টি দল মহাজোটে যোগ দিতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বেশিরভাগ দলেরই নিবন্ধন নেই। এসব দলের সবাইকে সঙ্গে নেয়া বা না নেয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও ৩টি জোটের নেতৃত্বে প্রায় ৮৯টি দল মহাজোটে যুক্ত হতে পারে। বাকি দলগুলোর ব্যাপারেও আলোচনা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত ১৪ দলীয় জোটের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ৫৮ দলের ইউনাইটেড ন্যাশনাল এলায়েন্স (ইউএনএ) এবং সাবেক বিএনপি নেতা নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ৩১ দলের বাংলাদেশ ন্যাশনাল এলায়েন্স (বিএনএ) ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগ দেয়ার পর ১০৩টি দলের নেতৃত্ব চলে আসছে আওয়ামী লীগের হাতে। তাছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারার নেতৃত্বাধীন ৮ দলের যুক্তফ্রন্ট ও ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মিছবাউর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে সমমনা ১৮ দল নিয়ে গঠিত আইডিএ জোটও যুক্ত হচ্ছে সরকারি দলের সঙ্গে। ফলে আওয়ামী লীগের জোটে দলের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১২৯টি।
এর বাইরে আরও অন্তত ২০টি দল নিয়মিত ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। সংলাপেও অংশ নিয়েছে দলগুলো। তবে এসব দলের বেশিরভাগই নিবার্চন কমিশনে নিবন্ধিত নয়। অর্থাৎ দলগুলো নির্বাচনে আলাদাভাবে প্রার্থী দিতে পারবে না। এই দলের নেতারা স্বতন্ত্রভাবে বা নিবন্ধিত অন্য দলের মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থী হতে পারবেন।
এরপর বিভিন্ন সময় নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীকে আলাদা চিঠি দিয়েছে দলগুলো। গত ৭ অক্টোবর ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ৩১ দলের জোটের পাশাপাশি সংলাপে অংশ নেয় ১৮টি দল নিয়ে গঠিত জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট- এনডিএ। এর বাইরেও কয়েকটি ছোট দল অংশ নেয়। এর মধ্যে তৃণমূল এনডিএম নামের একটি দলও সংলাপে অংশ নেয়। দলের নেতারা জানান, আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও নিবার্চন কমিশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির চেয়ারম্যান খোকন চৌধুরী বলেন, সংলাপে প্রধানমন্ত্রী আশস্ত করেছেন। সরকারের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের প্রতি সম্মান জানিয়ে তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে নির্বাচন করার জন্য আগামী সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে জানান তিনি। তাছাড়া অন্য ছোট দলগুলোও একই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে বলে জানিয়েছে দলের একটি সূত্র।
মহাজোট সূত্রে জানা গেছে, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসলেও এরশাদ, মিছবাউর রহমান ও বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জোটগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রায় চূড়ান্ত। রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে জোট সম্প্রসারণের ঘোষণা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না এলে এসব দলকে আসন ছেড়ে দিয়ে আলাদা নির্বাচন করতে বলা হতে পারে। তাছাড়া নামসর্বস্ব সব দলকে মহাজোটে অন্তর্ভুক্ত করতে গেলেও জটিল সমস্যায় পড়তে হবে। আবার তাদের ছেড়ে দিলে বিরোধী জোটে যোগ দিতে পারে। এমন চিন্তায় আপাতত চূড়ান্ত ঘোষণা দিতে চাচ্ছেন না জোটের নীতিনির্ধারকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৪ দলীয় জোটের একজন প্রভাবশালী নেতা জানান, ১৪ দলীয় জোট ১৪ দলীয়ই থাকবে। এখন যারা আসতে চায় তাদের নিয়ে নির্বাচনী জোট হতে পারে। তবে নির্বাচনের এসব জোট নিয়ে আগেভাগেই কোনো ঘোষণা দিতে চাচ্ছেন না। শেষ মুহুর্তে পরিস্থিতি বোঝে ঘোষণা হতে পারে।
এদিকে আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জোটের পরিধি বড় করতে বিভিন্ন ছোট দলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে করছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা। কিছু ছোট দল নিজেদের উদ্যোগে যোগাযোগ রক্ষা করছে । দেশের অপর বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোটের পাশাপাশি ঐক্যফ্রন্ট যুক্ত হওয়ায় তাদের হালকাভাবে নিচ্ছে না সরকারি দল। তাই নামসর্বস্ব ছোট দলগুলোকে হাতছাড়া করে বিরোধীদের পাল্লা ভারী করতে চায় না ক্ষমতাসীনরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাসান মাহমুদ বলেন, মহাজোট সম্প্রসারণ হতে পারে। তবে কত দল থাকবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জাতীয় পাটির্ আগে থেকেই মহাজোটে আছে। সম্মিলিত জাতীয় জোটের ৫৮ দলের মধ্যে এখন পর্যন্ত শুধু জাতীয় পার্টিই মহাজোটে আছে। তাদের জোটের দলগুলোকে নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে তারা আসতে চায়। নাজমুল হুদার জোট সম্পর্কেও একই রকম মন্তব্য করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুক্তফ্রন্টের যে দলগুলো আছে তারা সবাই মহাজোটে থাকার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এরবাইরেও কিছু দল নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।
চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র এবিএম রহুল আমীন হাওলাদার বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচন করলে সম্মিলিত জাতীয় জোটের সব দলকে নিয়েই করবেন বলে জানান তিনি।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সরকারবিরোধী সমমনা দল নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হয়। পরবর্তীতে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গেও নির্বাচনী জোট করে আওয়ামী লীগ। এরপর ১৪ দলীয় জোট আর এরশাদের জাতীয় পার্টি মিলে ‘মহাজোট’ গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। অবশ্য ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রধান বিরোধী জোট ওই নির্বাচন বর্জন করায় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। এরপর ২০১৭ সালে ৫৮টি দল নিয়ে আলাদা জোট গঠন করেন তারা। বিভিন্ন সময় ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তবে শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে না এলে আলাদাভাবে নির্বাচনের চিন্তাও আছে তাদের।
এরশাদের নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোটে ৫৮ দল : এ জোটে নিবন্ধিত দল সংখ্যা ২টি। জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট। জাতীয় ইসলামী মহাজোট ও বাংলাদেশ জাতীয় জোটের (বিএনএ) সমন্বয়ে সম্মিলিত জাতীয় জোট করা হয়েছে। জাপার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী মহাজোটে ৩৪ ও বিএনএতে ২২টি দল নিয়ে জোট শুরু হয়। পরবর্তীতে আরও দুটি দল তাদের জোটে যোগ দেয়।
বিএনএতে ২২ দল : ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, আওয়ামী পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ প্রতিবাদী জনতা পার্টি, বাংলাদেশ তফসিল ফেডারেশন, বাংলাদেশ সচেতন হিন্দু পার্টি, ইউনাইটেড মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ গণজাগরণ পার্টি, বাংলাদেশ গ্রামীণ পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামিক গণতান্ত্রিক লীগ, তৃণমূল লীগ, গণ-অধিকার পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল মাইনরিটি পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ জনতা ফ্রন্ট, জাতীয় হিন্দু লীগ ও বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি।
ইসলামী মহাজোটের ৩৪ দল : জাতীয় ইসলামী জোট, ওলামা মাশায়েখ সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফেডারেশন, জমিয়তে মুসলেমিন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামিক লীগ, শরিয়া আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জনতা পার্টি, খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ ইসলামিক জনকল্যাণ পার্টি, জাতীয় শরিয়া আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী গণআন্দোলন, জাতীয় ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় ইসলামিক মুভমেন্ট, ইসলামি মূল্যবোধ সংরক্ষণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, ন্যাপ ভাসানী, বাংলাদেশ ইসলামী আক্বীদা সংরক্ষণ আন্দোলন, খেদমতে খালক পার্টি, বাংলাদেশ ইত্তেহাদুল মুসলেমিন, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট বই পার্টি, হেফাজতে মুসলেমিন বাংলাদেশ, খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত বাস্তবায়ন পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, মুসলিম জনতা পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফাতুল উম্মাহ, বাংলাদেশ আকিমুদ্বীন মজলিশ, ইসলামী আক্বীদা সংরক্ষণ পার্টি, ইউনাইটেড ইসলামিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ইসলামী পার্টি, ইসলামী সমাজকল্যাণ আন্দোলন এবং লিবারেল পার্টি বাংলাদেশ।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্টে ৮ দল : যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়া দলগুলো হলো- সাবেক মন্ত্রী নাজিম উদ্দিন আজাদের বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি), সাবেক সংসদ সদস্য এইচ এম গোলাম রেজার জাতীয় পার্টি (জাফর), খন্দকার গোলাম মর্তুজার এলডিপি, মাহবুবুর রহমান জয়ের বাংলাদেশ জনদল, ২০ দল থেকে বেরিয়ে আসা হামিদুল্লাহ আল মেহেদির বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও জেবেল রহমান গানির বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), দীলিপ কুমার দাসের বাংলাদেশ মাইনরিটি ইউনাইটেড ফ্রন্ট ও কামাল পাশার গণফ্রন্ট।
তাছাড়া ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন ৩১টি দল নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ) সরকারের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেছে। তরীকত ফেডারেশনের নেতা ও সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল ও বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আলহাজ মিছবাউর রহমানের নেতৃত্বে সমমনা ১৮টি ইসলামী দলের জোটও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সূত্র: যায়যায়দিন