বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩২ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :

১৫ আগস্ট শুধু শোকের নয়, আত্মশুদ্ধিরও…

বাংলাদেশের ৭৫-এর ১৫ আগস্টে ঢাকার ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িতে যে বর্বরতা হয় তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোন রক্তাক্ত ক্যুরই তুলনা হয় না। ক্ষমতাসীন সরকারের সকল আমল থেকেই দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে দিনটিকে শুধু শোকের বললে সম্পূর্ণ হবে না। দিনটি জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার, দিনটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার। এই বিশ্বাসঘাতকতা নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার চেয়ে অনেক বড় বললে ভুল হবে না। সভ্যতার ঝলমলে বিবর্তনে পঁচাত্তর এক কালো অধ্যায় যেদিন মানবতা ডুকরে কেঁদেছিল। ১৯৭৫ এর এই দিনে অতিপ্রত্যুষে ঘটেছিল ইতিহাসের সেই কলঙ্কজনক ঘটনা। মূলত এটা ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রতিশোধ, স্বাধীনতা বিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ।

আওয়ামীলীগকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। সেই নৃশংস ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিল, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শহিদ সেরনিয়াবাত, বেবি সেরনিয়াবাত, শিশু সুকান্ত বাবু এবং আরিফ খান রিন্টুসহ অনেকেই। তবে স্বামীর উচ্চ শিক্ষার জন্য জার্মানিতে থাকার কারণে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর অত্যন্ত আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা। বাঙ্গালি জাতির জন্য প্রতি বছরই আগস্ট মাস আসে সত্যিই কিছু না কিছু শোকের বার্তা নিয়ে ফিরে আসে। আগস্ট মাস আসলেই মনে পড়ে ১৫ আগস্টের ইতিহাসের জঘন্যতম সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের কথা।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামীলীগ দলীয় এক জনসভায় আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এক শক্তিশালী গ্রেনেড হামলা করা হলে তিনি পরম করুণাময়ের অশেষ দয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলেও সেখানে তাৎক্ষনিকভাবে ২৪ জন বিশিষ্ট লোক প্রাণ হারান। পরবর্তী সময়ে স্প্লিন্টারের আঘাতে তৎক্ষালীন মহিলা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ অনেক নেতাকর্মী নিহত হন এবং দীর্ঘদিন শরীরে গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টার এর যন্ত্রণা বহন করে সাবেক প্রথম ঢাকা সিটি মেয়র মোহাম্মদ হানিফও মারা যান। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি নামক জঙ্গি সংগঠন তাদের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি জানাতে ৬৩ জেলায় একযোগে সুপরিকল্পিতভাবে বোমা হামলা ঘটিয়েছিল।

তারই ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহ সিনেমা হলে, রমনা বটমূলে বোমা মারাসহ সারাদেশে বোমাতঙ্ক তৈরি করা হয়েছিল। মূলত এসব ঘটনাগুলো কোন না কোন আগস্ট মাসেই হয়েছে এবং সবই এক সূত্রে গাঁথা। পাকিস্তানি শাসকচক্র শেখ মুজিবকে হত্যা করতে চেয়েছিল, বিচারের নামে প্রহসন করে বহুবার তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিল কিন্তু পারে নি। অথচ স্বাধীন দেশে তাঁকে জীবন দিতে হল তাঁর প্রিয় বাঙ্গালির হাতেই। অনেকেই তাঁকে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে সতর্ক করা সত্ত্বেও সেসব তিনি আমলে নেননি। কারণ তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলতেন যাদেরকে তিনি জীবন দিয়ে ভালবাসেন সেই বাঙ্গালিদের কেউই তাঁকে মারতে পারে না, পারবে না। বিবিসি’র জরিপে যখন শেখ মুজিবকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি হিসেবে নির্বাচিত করা হয় তখন কারও কারও মধ্যে যে বিস্ময় দেখা দেয়নি তা কিন্তু নয়। তিনি বাঙ্গালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জনক।

তিনি একদিকে যেমন ইতিহাসের নায়ক, বরপুত্র অন্যদিকে তিনি ইতিহাস স্রষ্টা। তিনি শত প্রতিকুলতায়ও আমরন বাংলার মানুষের সুখ, দুঃখের সঙ্গী ছিলেন। শেখ মুজিব উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোন নেতা ছিলেন না। তিনি ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে উপরে উঠেছেন। কারও তৈরি করা সিঁড়ি বেয়ে নয়, নিজের তৈরি করা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু কখনও প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন নি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্যও তাঁর হৃদয়ে ছিল সহানুভুতি ও ভালবাসা। উদাহরণ হিসেবে- একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কারণে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, খুলনার আব্দুস সবুর খান স্বাধীনতার পরে জেলে গেলেও বঙ্গবন্ধু তাদের প্রতি সদয় ছিলেন, খোঁজ-খবর নিতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে যে প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান।

জাতি হিসেবে আজ আমরা এতটাই অসংহত যে, ১৫ আগস্টের অর্থ সবার কাছে একই রকম নয়। এই দিনটি সীমাহীন শোকের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কাছে এবং আরও যারা সেদিন জীবন দিয়েছেন তাদের অন্যান্য পরিবার-পরিজনদের কাছে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবির পাশে নিজেদের ছবি দিয়ে বিলবোর্ড, ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টার যারা সারাদেশের রাস্তাঘাট, বৃক্ষের কাণ্ড ও ডালপালায় সেটে দেন তাদের কাছে ঐ দিনটি কি তাৎপর্য বহন করে তা শুধু নিজেরাই বলতে পারবেন। আর যারা চাঁদা তুলে গরু-খাসি জবাই দিয়ে ১৫ আগস্ট পালন করেন তাদের কাছে দিনটি নিশ্চয় অন্য অর্থ বহন করে। অন্যদিকে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ, আওয়ামীলীগ ও তাঁর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে যারা অন্তরে লালন করেন তাদের কাছে ১৫ আগস্ট অবশ্যই দুঃখের দিন।

আজ যারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবি করেন, তাদের উচিৎ হবে মানুষের মন জয় করার রাজনীতিতে মনযোগী হওয়া। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থের চেয়ে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থকে বড় করে দেখতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসা মেকি বলেই প্রতিভাত হবে। একাত্তরের পরাজিত শক্তিই পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গড়া দল আওয়ামীলীগ এখন ক্ষমতায়। আর তাঁর স্বপ্নের দেশ গড়ার দায়িত্বে আছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের অগ্রযাত্রার মূলশক্রি। শুধু মুজিব কোট গায়ে চাপালেই মুজিবপন্থী হওয়া যায় না। মুজিবের স্বপ্ন ও আদর্শ রুপায়নে একাত্তরের মত বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের শপথ নিতে হবে। সেই শপথ গ্রহণের মাস এই আগস্ট মাস। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসকে কঠোরভাবে রুখে দাঁড়ানোর মাস এই আগস্ট মাস। আত্মপ্রতারণা পরিহার করে আমাদের সবারই আত্মশুদ্ধি করা প্রয়োজন।  বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতিতে ফিরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা উচ্চারন করেই এবার পালিত হোক জাতীয় শোক দিবস।

 

নাজমুল হোসেন

প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক

ই-মেইলঃ nazmulhussen@yahoo.com

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com