রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:২৫ অপরাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক : একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আজীবন লড়াই করে যাওয়া একাত্তরের রণাঙ্গণের যোদ্ধা বীর উত্তম চিত্ত রঞ্জন দত্তের (সিআর দত্ত) প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সি আর দত্ত ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। তিনি ছিলেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি এবং বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
মঙ্গলবার সকালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জাতীয় পতাকায় মুড়ে সি আর দত্তের কফিন নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে। ঢাকার জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলামের উপস্থিতিতে এই মুক্তিযোদ্ধাকে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান।
গার্ড অব অনার দেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারের কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা আর সাবেক সহকর্মীরা যেমন সি আর দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন, তেমনি এসেছিলেন বিভিন্ন দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
সি আর দত্তের ছেলে চিরঞ্জিত দত্ত ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে সাংবাদিকদের বলেন, “বাবাকে আমরা ভিন্নভাবে দেখেছি নানা সময়ে। এ দেশ নিয়ে তিনি সব সময় স্বপ্ন দেখতেন। কত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি দেশের জন্য লড়াই করেছেন।
“বাবার স্বপ্ন ছিল এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। তিনি সারা জীবন সে লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। কোনো কিছু নিয়ে তার কখনও কোনো আক্ষেপ ছিল না। দেশকে তিনি হান্ড্রেড পারসেন্ট ভালোবাসতেন।”
সি আর দত্তের মেজ মেয়ে চয়নিকা দত্ত বলেন, “বাবার সবটুকু স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে। সোনার বাংলার উন্নতি হবে কীভাবে তাই নিয়ে ভাবতেন তিনি।”
বড় মেয়ে মহুয়া দত্ত এবং ছোট মেয়ে কবিতা দাসগুপ্তও বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন ঢাকেশ্বরীর প্রাঙ্গণে।
স্ত্রীবিয়োগের পর গত কয়েক বছর ধরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন সি আর দত্ত। ২৫ অগাস্ট ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় ৯৩ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা।
তার মরদেহ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে পৌঁছানোর পর সোমবার রাখা হয় ঢাকা সিএমএইচের হিমঘরে। মঙ্গলবার সকালে পরিবার ও স্বজনদের শেষ দেখার জন্য কফিন নেওয়া হয় তার বনানী ডিওএইচএসের বাসায়। সেখান থেকে সকাল সোয়া ৮ টার দিকে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় সি আর দত্তের মরদেহ।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন,
“তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সংগঠক। দেশের যে কোনো ক্রান্তিকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। রণাঙ্গনে তার সাহসী ভূমিকা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। জাতির পিতার যে স্বপ্ন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তার অনন্য ভূমিকা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।”
মিলন কান্তি দত্তের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ আর শৈলেন নাথ মজুমদারের নেতৃত্বে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি সি আর দত্তের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকেও সি আর দত্তের প্রতি জানানো হয় ফুলেল শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “সি আর দত্তের উপর যখন যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তা তিনি কর্তব্যনিষ্ঠ থেকে সততার সঙ্গে পালন করেছেন। দেশের প্রতি তার নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম ছিলো অতুলনীয়।
“জেনারেল এরশাদ যখন তার সামরিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে দেশের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করতে চেয়েছিলেন, তখন সি আর দত্ত সেখানে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। যেখানে অসত্য, অসাম্য তিনি দেখেছেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, “আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, সেখানে সি আর দত্তের আদর্শ সামনে রেখে এগোলে আজ হোক, কাল হোল তা বাস্তবায়িত হবেই।”
সকাল সাড়ে ১০টায় সিআর দত্তের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে সবুজবাগের রাজারবাগ শ্মশানে। সেখানেই হবে শেষকৃত্য।
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের রাজধানী শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন সি আর দত্ত। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ছিলেন পুলিশ অফিসার। পরে তারা স্থায়ীভাবে চলে আসেন হবিগঞ্জে।
১৯৫১ সালে তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চার বছরের মাথায় পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন সি আর দত্ত।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের চূড়ান্ত মুহূর্ত যখন উপস্থিত, সে সময় ছুটিতে দেশেই ছিলেন সি আর দত্ত। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মেজর।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত সি আর দত্ত মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর তাকে দেওয়া হয় ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব।
সিলেট অঞ্চলে ওই সেক্টরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার বেশ কয়েকটিতে নিজেই নেতৃত্ব দেন সি আর দত্ত।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্ব ও অবদানের জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহা পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।