শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৫ অপরাহ্ন
আরিফুর রহমান : আমার পড়াশোনা সিলেট ক্যাডেট কলেজে। ৮৩ সালে সিলেট ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য জীবনের প্রথম সিলেট যাই, রেল স্টেশন থেকে ক্যাডেট কলেজের দিকে যেতে প্রায় ২/৩ টা চা-বাগান পার হতে হতো। আমার ছোটবেলাটা চা-বাগানের মাঝেই কেটেছে। ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়ে মিলিটারি একাডেমিতে জয়েন করি। সেখান থেকে চলে আসি চা-বাগানে এবং আবার সেই চা-বাগান দেখা হয়। নতুন করে অনেক বছর পর চা-বাগান দেখে মনে হলো, যেসব পর্যটক চা-বাগানে ঘুরতে আসে, তাদের বেশিরভাগেরই যথাযথভাবে চা-বাগান দেখার সুযোগ হয় না। চা-বাগানে যাদের পরিচিত কেউ নেই, তাদের জন্য চা-বাগানের ভেতরে গিয়ে রাত কাটানোটা প্রায় অসম্ভব। ওই সময় চা-বাগানে কারো পরিচিত থাকলে, তা ছিল স্বর্গ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার। বাকিরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা-বাগানের পাশে দু-একটা ছবি তুলে চলে আসত। এই ছিল তখনকার ঘোরাঘুরির চিত্র। এসব দেখে আমার মনে হলো, বাংলাদেশের মানুষের কাছে চা-বাগানটা সুপরিচিত নয়। ওইভাবে আলোর পাদপ্রদীপে আসেনি। সঙ্গে এও মনে হলো, চা-বাগানের ভেতরে যদি থাকার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে সেটা হবে মানুষদের চা- বাগানের সঙ্গে পরিচিত করার বড় মাধ্যম।
ক্যাডেট কলেজে আমার এক রুমমেট ছিল, নাম তাপস। সে আর্মিতে ছিল। এক রাতে আমাকে ফোন করে বলল, একটা জায়গা আছে পাহাড় আর অরণ্যঘেরা, হবিগঞ্জ এবং শ্রীমঙ্গলের বর্ডারে। গিয়ে দেখা যেতে পারে। কিন্তু রাস্তা নেই।
আমি বললাম, রাস্তা নেই, জায়গা আছে, তাহলে কীভাবে এখানে কাজ হবে? পরে রাস্তা ছাড়াই গিয়ে জায়গাটা দেখলাম, পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। জায়গাটা খুব সুন্দর। সে জায়গার একটা বড় অংশের মালিক ছিলেন আমার পার্টনার এবং ক্যাডেট কলেজের সিনিয়র কামাল ভাই। কিন্তু বাদ বাকি জায়গা অন্য লোকের। তো সেসব জায়গা আমরা আস্তে আস্তে কিনে নিই। এই জায়গাটা পছন্দ হওয়ার মূল কারণ, এর তিন দিকে তিনটা চা-বাগান। আমাদের শুরুতেই পরিকল্পনা ছিল—এখানে যারা আসবেন, ডাইনিংয়ে বসে খেতে খেতে তাদের যাতে শুধু চা-বাগানই চোখে পড়ে! সেভাবেই পুরোটা সাজিয়েছি। সে জন্য অবশ্য কিছু অসাধ্য সাধন করতে হয়েছে।
এখন এই জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেক কথাই মনে পড়ছে। আমি চা-বাগানে চাকরি করতে গিয়ে যেটা দেখেছি—গাছই হচ্ছে চা-বাগানের সৌন্দর্য। গাছ নেই মানে কিছুই নেই। গাছ ছাড়া এখানকার সৌন্দর্যটা পাওয়া যায় না। আমাদের এই প্যালেসের ডিজাইন দু’দফায় করা হয়েছে। প্রথমে ঢাকায় একজন করেছিলেন, উনি সব গাছ কেটে একটা ডিজাইন করেছিলেন, ওটাও সুন্দর ছিল কিন্তু গাছ ছিল না। পরে আমি চায়না যাই একজন আর্কিটেক্টের সঙ্গে দেখা করতে। উনি বললেন, তুমি কেন গাছ কাটবে? গাছ রেখেই তো খুব সুন্দরভাবে এটা করা সম্ভব। উনি প্রথমে আমাদেরকে থিমটা দিলেন। পুরো ডিজাইনটা উনি করেননি কিন্তু। থিমটা দেওয়ার পর বাকিটা আমরা বন্ধু-বান্ধব মিলে করেছি। মজার ব্যাপার হলো আমরা যারা এই কাজটা করেছি, তারা সবাই বৃক্ষপ্রেমী। তো সে কারণে গাছ কাটার চিন্তা কারো মাথায় আসেনি। আমাদের প্রথম থেকেই প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ছিলেন হাসান। এখন তিনি আর আমাদের সাথে নেই, তারও চা-বাগানে চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল, পড়েছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারও কথা ছিল গাছ থাকতে হবে। গাছ থাকার বিষয়টা একদম পরিকল্পনার প্রথম থেকেই চলে এসেছে।
প্যালেস তৈরি করা হয়েছে এখানকার পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ নজর রেখে। কোনো গাছ কাটা হয়নি, কোনো পাহাড়ও কাটা হয়নি। পাহাড়ের সঙ্গে পাহাড়ের সংযোগ করতে হয়েছে স্টিলের ব্রিজ দিয়ে। এ কারণে আমাদের খরচ অনেক বেড়েছে এবং পুরো রিসোর্টে বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে মাটির নিচ দিয়ে। যাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভারসাম্য থাকে। সে কারণে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে এবং যারা ঘুরতে আসেন তাদের কাছ থেকেও টাকা খানিকটা বেশি রাখতে হয়। এসব বিবেচনায় নিয়েও বলব— একটি আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন ডেসটিনেশন হয়েছে প্যালেস এবং আমরা সেভাবেই এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি। সামনে ওয়াটার গেমস আসছে। আমি যেহেতু কিছুদিন মিলিটারি একাডেমিতে ছিলাম, ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনা করেছি। আমাদের যেরকম শারীরিক কসরত করতে হয়েছে আমাদের বাচ্চারা এখন আর সেভাবে দৌড়াদৌড়ি-খেলাধুলা করে না। সেজন্য আমরা কোর্সের মতো একটা প্ল্যান করছি। যাতে বাচ্চারা একটু অনুশীলন করতে পারে। ঢাকার যেসব স্কুল আছে—তারা যেন বছরে একটা শিক্ষাসফর করতে পারে। সেরকম একটা পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে এগোচ্ছি।
আমার কথা শুনলে অনেকে হয়তো বা খারাপভাবে নেবে, কিন্তু এটা সত্যি যে—এ সময়ের শহুরে বাচ্চারা আমগাছ কোনটা জামগাছ কোনটা তাও বলতে পারবে না। ওরা ভাবে এসব বোধহয় ফ্রিজ থেকেই আসে। আমরা সে জন্য ওখানে প্রচুর ফলের গাছ লাগিয়েছি, ফুলের গাছ লাগিয়েছি। আমাদের ভাবনা ছিল—ওই ফল, ফুল দেখে বাচ্চারা শিখবে কোনটা ফলের গাছ আর কোনটা ফুলের। সে চিন্তা থেকেই করা হয়েছে দ্য প্যালেস। ভবিষ্যত্ বলবে এটা কতটুকু কাজে দিয়েছে। সামনে আমরা আরো গাছ লাগাচ্ছি। কারণ আমাদের প্রচুর জায়গা আছে, আমরা আরো নতুন সব গাছ লাগাচ্ছি। শুরুতেই আমাদের এটা নিয়ে পরিকল্পনা ছিল। আমাদের এটা পুরোটাই একটা গ্রাম। পুটিজুরী সেখানের একটা ইউনিয়ন। আমাদের প্রজেক্টটা ওখানেই। এটা তো শ্রীমঙ্গল শহর না বা অভিজাত শহরও না যে, আপনি বের হয়ে আরেক জায়গায় যাবেন। ফলে আমরা চেয়েছি থাকার পূর্ণাঙ্গ একটা জায়গা তৈরি করতে।
প্রথমে আমাদের অন্যরকম পরিকল্পনা ছিল। কাজের মাঝামাঝি এসে বুঝতে পারি আমরা যা বানাচ্ছি, তা খুব ব্যয়বহুল। এমন একটা কাজের জন্য সাহস নয়, তার থেকে আরো বেশি কিছুর দরকার। আমরা যখন বুঝতে পারি খুব ভালো কিছু একটা হচ্ছে, তখন এত ব্যয়, এত শ্রম সবকিছুই আনন্দে পরিণত হয়। মনে হয়, আমরা এমন কিছু একটাই তো চাচ্ছিলাম প্রথম থেকে। কারো এর ভেতরে ঢুকে যাতে দু’তিন দিন বের না হতে হয়। সে সিনেমা দেখবে, সুইমিং করবে, মাছ ধরবে—এরকম নানা আনন্দযজ্ঞ রেখেছি আমরা, একই সঙ্গে কেউ যদি নিজের মতো থাকতে চায়, তারও পুরো আয়োজন আছে এতে। সামনে ওয়াটার গেমসও রাখছি। বাচ্চারা ওয়াটার গেমসে ব্যস্ত থাকবে, ফার্মিং করবে, কীভাবে ফুলকপি কাটে, বাঁধাকপি কাটে, কীভাবে টমেটো পাড়ে সে জিনিসগুলোও সংযোজন হবে। সে জিনিসগুলো যখন থাকবে, আমার কাছে মনে হয় না যে আর বের হতে হবে। তাছাড়া আমরা বন বিভাগের একটা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি। ওটা হলে ভেতরে হরিণ বা ক্ষতিকর নয়, এমন তৃণভোজী কিছু প্রাণী রাখব—জিনিসটা যাতে আরো নৈসর্গিক হয়ে ওঠে। আরেকটা বিষয়—ভেতরের স্টাফদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। প্যালেসের স্টাফদের একটা বড় অংশ অর্থাত্ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশেরই দুবাইতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ওরা দুবাইয়ের বিভিন্ন ফাইভ স্টার, ফোর স্টার, থ্রি স্টার হোটেলে কাজ করেছে। ওরা বড় প্রপার্টি দেখে এসেছে, বড় প্রপার্টি কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, এটা তাদের জানা। তাই ওরা সেভাবেই দ্য প্যালেসকে সাজানোর চেষ্টা করছে। আমরা বাইরে থেকে ইনপুট দিই। এমনকি দ্য প্যালেসের স্টাফ যারা, ওরা দুবাইয়ের বড় বড় হোটেলে যেসব ইনপুট দিয়েছে—সেগুলোও আমরা আমাদের এখানে করার ট্রাই করছি।
অর্জনের কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলব, আপনারা যখন বলেন ব্যতিক্রমধর্মী বা এত বড় বিনিয়োগের সাহস কীভাবে করলাম, এগুলোই আমাদের অর্জন। এর বাইরে বলা যায়, দেশের একটা অংশ যারা কিছু হলেই হুট করে দেশের বাইরে চলে যান, তাদের একটা বড় অংশ দেশের ভেতরেই এখন রিসোর্ট নিতে পারছেন। পাচ্ছেন আন্তর্জাতিকমানের হোটেল সেবা। যে কারণে অনেকেই আসেন। কেউ কেউ হয়তো একবার গিয়েছেন, দু’বার গিয়েছেন, পরে আর যাচ্ছেন না। কিন্তু আমার ধারণা তারাও যাবেন। আরো দুই-একবার দেশের বাইরে ঘুরেটুরে এসে তারা আবার থিতু হবেন দেশে। আর এরমধ্যে আশার কথা হলো, ঢাকা-সিলেট ৪ লেন প্রজেক্টটি। আমরা শুনেছি, এটা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা আছে। যখন ঢাকা-সিলেট ৪ লেন হয়ে যাবে, তখন মনে হয় যাতায়াতটাও অনেক সহজ হয়ে উঠবে। আরো বেশি লোক তখন প্যালেসে যেতে পারবে। অর্জন এটা একটা। আরেকটা হচ্ছে দেশের বাইরে যে দেড়-দু’শো লোক চাকরি করত, তারা এখন পরিবারের কাছে এসে থাকতে পারছে। তারা দুবাই ছেড়ে এসে এখানে কাজ করতে পারছে। তারা কেউ ১৭ বছর, কেউ ১৮ বছর, কেউ ৯ বছর, কেউ আবার ১০ বছর ট্যুরিজম সেক্টরে কাজ করেছে দুবাইতে। দুবাই তো এখন ট্যুরিজমের ওয়ান অব দ্য বিগেস্ট হাব ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। সেই হাবে কাজ করে ওরা যা শিখছে, সেই ইনপুটটা তারা এখানে দিতে পারছে। ওরা বাংলাদেশে ফিরলে যে চাকরি পেতে পারে, আগে সে ধারণা ছিল না। দুবাইয়ের বাইরে বোধহয় আর চাকরি নাই—সেটা মনে করে দুবাই থেকে ওরা আসত না। এখন এখানে আসতে পারে, আসছে।
পরিবেশ উন্নয়নেও আমাদের একটা ভূমিকা আছে। সে কারণে আমরা একটা পরিবেশ পদক পেয়েছি। তখন পরিবেশমন্ত্রী ছিলেন জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। কোন প্রতিষ্ঠানের বহুসংখ্যক গাছ
আছে—গভর্নমেন্টে এরকম একটা ক্যাটাগরি রয়েছে। সেই ক্যাটাগরিতে আমরা প্রথম পুরস্কারটা পেয়েছিলাম। আমাদের পদকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধানমন্ত্রী পদক ও পরিবেশ পদক। আরেকটা যেটা হয়েছে সেটা হলো—আমাদের যারা গেস্ট তারা বিভিন্ন জায়গায় রিভিউ দেন, সেই রিভিউর ওপর ট্রিপ অ্যাডভাইজ দুনিয়াজুড়ে ঠিক করে যে কারা সার্টিফিকেট অব এক্সিলেন্স পাবে। সে হিসেবে আমরা ২০১৮ সালের রিসোর্ট ক্যাটাগরিতে ট্রিপ অ্যাডভাইজের সার্টিফিকেট অব এক্সেলেন্স পেয়েছি।
দ্য প্যালেস -এর আরেকটা মজার গল্প হচ্ছে এটা রূপালী ব্যাংক লিঃ-এর একটা প্রজেক্ট। সরকারি ব্যাংকের অর্থায়নে যে অসাধারণ একটা প্রজেক্ট হতে পারে দ্যা প্যালেস তার উদাহরণ। রূপালী ব্যাংক-এর ম্যানেজমেন্ট এবং বোর্ড উভয়ের সহযোগিতায় আমরা পেরেছি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় বেশ কয়েকবার দ্য প্যালেস ভিজিট করেছেন। এমনকি সরকারি বেশ কয়েকটা সেমিনারও আমাদের এখানে হয়েছে। এ সবই আনন্দের এবং গর্বের।
লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দ্য প্যালেস।
অনুলিখন: মনিরুল ইসলাম শামিম, বাহুবল প্রতিনিধি, বাংলাদেশের খবর।