রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৪ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক: ক্রমেই দেশে করোনাভাইরাসে শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। ইতোমধ্যে দেশে দৈনিক ২৩০ জনের মৃত্যু ও সাড়ে ১৩ হাজার শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়গুলোর সঙ্গে এপ্রিল-মে মাসের তুলনা করলেও করোনার ভয়াবহতা ফুটে উঠবে। তথ্যমতে, দেশে দৈনিক করোনায় শনাক্তের হার বিবেচনায় এশিয়ার সব দেশকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। আর সারাবিশ্বের মধ্যে শনাক্ত বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন চতুর্থ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের (সিআরআইডিএ) বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিষ্ঠানটির দেয়া তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে আক্রান্ত প্রতি ১০০ জনের ৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে। অথচ এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ছিল ৫ শতাংশ। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচক ১-এর বেশি হওয়ায় এবং দৈনিক শনাক্তের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে শনাক্ত এবং মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি।
এমন অব্স্থায় হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করে সিআরআইডিএ।
মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শাহরিয়ার রোজেন করোনার পরিসংখ্যান নিয়ে তাদের মূল্যায়ণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সিআরআইডিএর পক্ষ থেকে জানানো হয় পুরো বিশ্লেষণসহ সার্বিক প্রক্রিয়ায় সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের এপিডেমিওলজি বিভাগের ডা. কেএম তৌহিদুর রহমান, ডা. শাহরিয়ার রোজেন, ডা. নাজিফ মাহবুব, ডা. নওরিন আহমেদ, ডা. মামুনূর রহমান যুক্ত ছিলেন।
সিআরআইডিএর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনার দৈনিক শনাক্তের হার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং এশিয়াতে প্রথম। গত ৭ই জুলাই সারা বিশ্বে নামিবিয়া, মেক্সিকো এবং তিউনিশিয়া এর পরেই ছিল বাংলাদেশের অবস্থান। গত ১৫ দিনে বাংলাদেশে দৈনিক শনাক্তের হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২ গুণেরও বেশি। গত ২৬ জুন দেশে দৈনিক শনাক্তের হার ছিল ১৫.৭ শতাংশ, ১২ জুলাই সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.২৪ শতাংশে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।
জুনের ১৩ তারিখ থেকে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচক (রিপ্রোডাকশন রেট) এদেশে ১.৩ এর বেশি। অর্থাৎ, গত এক মাস ধরে সংক্রমণ প্রতি ১০০০ জন থেকে ১৩০০ জনে ছড়িয়ে পড়ছে।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ টেস্ট না করার কারণে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রটি বোঝা যায় না। যে সকল দেশে টেস্ট কম হয় সে সকল দেশের সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য উপযুক্ত সূচক হলো ‘শনাক্তের হার’ এবং ‘রিপ্রোডাকশন রেট’। রিপ্রোডাকশন রেট (সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচক) ১-এর বেশি হওয়ায় এবং দৈনিক শনাক্তের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আমরা এখনো সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছাইনি- অর্থাৎ, আগামী দিনগুলোতে শনাক্ত এবং মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নিকট ভবিষ্যতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভবনাও কম। এই মুহূর্তে তাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর উপর।
গত ২৩ জুন ও ৪ জুলাই এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সারা দেশেই আই সি ইউ শয্যায় ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৬ শতাংশে উন্নিত হয়েছে, যা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১১ জুলাই ৭৬ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ নতুন আক্রান্ত রোগীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাকেই মারাত্মক কোভিডজনিত জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একইভাবে সাধারণ শয্যাসমূহেও ভর্তিরত রোগীর সংখ্যায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত তিন সপ্তাহ ধরে।
১১ জুলাইয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিআরআইডিএ জানায়, অতি উচ্চ সংক্রমণের জন্য দেশে বর্তমানে ১ লাখ ৩০ হাজারেও বেশি সক্রিয় করোনা রোগী রয়েছে এবং সারাদেশে ১১ হাজারেরও বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছে। গত এপ্রিলে দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় দিনে সক্রিয় করোনা রোগী ছিল প্রায় ১ লাখ।
ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে গুরুতর অসুস্থতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও দাবি সিআরআইডিএর।
২০২১ সালের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিআরআইডিএ জানায়, বর্তমানে আক্রান্ত রোগীর প্রতি ১০০ জনের ৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে, অথচ এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ছিল ৫ শতাংশ। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানতে না পারলে আগামী দুই সপ্তাহ পর সকল রোগীকে হাসপাতাল বা আই সি ইউ সেবা না দিতে পারার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। পাশাপাশি আগামী ঈদে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জনসমাগম ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের গতিতে নতুন মাত্রা সংযোজন করতে পারে। ভারতে মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল সবাইকে সবাইকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব না হওয়া। দেশের হাসপাতালে/আইসিইউতে সেবা দিতে হবে এমন রোগীর সংখ্যা হাসপাতালগুলোর সামর্থের বাইরে চলে গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে সংগঠনটি বলছে, লকডাউন একটি স্বল্পমেয়াদি সমাধান। আর মহামারি নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী সমাধান হলো টিকা। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে টিকা ও ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে প্রতিযোগিতায় টিকা জয়ী হচ্ছে। বাংলাদেশে করোনা মহামারির ভয়াবহ সংক্রমণের মূল কারণ হচ্ছে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অধিক সংক্রমণক্ষম যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট থেকেও কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বেশি সংক্রামক এবং হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে কিছুটা স্বস্তির বিষয় হলো যে অধিকাংশ ভ্যাকসিন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে কার্যকর। ফাইজার এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ ভ্যাকসিন গুরুতর অসুস্থতা বা করোনাজনিত মৃত্যু থেকে প্রায় শতভাগ সুরক্ষা দেয়। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধে ৯২ শতাংশ কার্যকর।
অপরদিকে, ফাইজারের ভ্যাকসিনের দুই ডোজ গুরুতর অসুস্থতা থেকে ৯৬ শতাংশ সুরক্ষা প্রদান করে। মডার্না, সিনোফার্ম এবং স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিন সম্পর্কে গবেষণার ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, মডার্না, সিনোফার্ম এবং স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিন করোনাজনিত গুরুতর অসুস্থতা থেকে প্রতিরক্ষা প্রদান করবে।
বাংলাদেশে খুব অল্প মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় আসায় (৪ শতাংশের কম) অধিকাংশ মানুষ প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে আছে- এমন দাবি করে তারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এখন আর কেবল সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন বা শাটডাউন দিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃত্ব এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশের শতকরা ৯৬ ভাগ জনগোষ্ঠী ভ্যাকসিনের আওতার বাইরে থাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।