সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৯ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; বিশ্বাসে, অনুভবে- পংকজ কান্তি গোপ টিটু

আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মবার্ষিকী। কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। জন্মের এতো বছর পরও জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। দেশে-বিদেশে সর্বত্র। আজো আমরা এই ভেবে বিস্মিত হই, কিভাবে একজন মানুষ সমান্তরালভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সকল শাখায় দৃঢ়তার সাথে হেঁটেছিলেন। বিশ্বের সফল মানুষের জীবনাচরণ ঘাটলে আমরা দেখি একটি বিষয়কেই তাঁরা আকড়ে ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। কেউ কেউ বড়ো জোর আরো দু’একটি বিষয়ে। যেমন- সেক্সপিয়র নাটককে ঘিরেই মেতেছিলেন। নাটকের কল্যাণে তিনি সাড়া বিশ্বে সমাদৃত হয়েছিলেন। কিংবা কীটস। যিনি কেবল কবিতা দিয়েই আপন আসন পাকাপোক্ত করেছিলেন। কিংবা আমাদের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের কথাই যদি বলি তিনিও তো কালজয়ী হয়েছিলেন উপন্যাসকে অবলম্বন করেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? সাহিত্যের কোন শাখাকে তিনি শাণিত করেননি ? বরং একাধিক শাখাকে নিজেই প্রতিষ্টিত করেছেন স্বমহিমায়। রবীন্দ্রনাথ তো কেবল গান আর কবিতার জন্যেই অমরত্ব পাওয়ার কথা।

ছোটগল্পের আজ যে জয় জয়কার, সেও তো এই পর্যন্ত হেটে এসেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই। তাঁর আগে ছোটগল্প লেখা হলেও, যথার্থ ছোটগল্প বলতে যা বোঝায়, তার স্রষ্ঠা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটগল্পের গঠন শৈলী, অন্তিম ব্যঞ্জনা, ভাষারীতি- যেকোণেই উত্তরকালীন লেখকদের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সমুদ্রপ্রতিম। শুধু ছোটগল্প কেন ? সাহিত্যের যেকোন শাখার ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। বিষয় ধরে ধরে রবীন্দ্র প্রতিভা বর্ণনা, এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখার যোগ্যতাও আমার নেই। এ দৃষ্টতাও আমি দেখাই না। বিশ্বের নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে রবীন্দ্র প্রতিভা নিয়ে আজো নিরন্তর গবেষণা হচ্ছে, সেখানে আমার দু-এক ছত্র লেখাতো বাঁচালতারই শামিল । তবে এ কথাও সত্য রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিশ্বাসে, আমাদের অনুভবে সদা জাগরুক | আমাদের জাগতিক বিষয়-আশয়ের সাথে এতো গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন যে, তাঁকে কখনো মনে হয়নি তিনি আমাদের দূরের কেউ | যারা সাহিত্যের নন্দনকাননের বিশাল সম্ভার থেকে ক্ষুদ্র দু-একটা পুষ্পের ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করেন কিংবা ওই কাননে জন্ম দিতে চান কোন তৃণের; তারা ভালো করেই জানেন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তারা কতটা অসহায় | সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের নিত্য বসবাস, রবীন্দ্রনাথতো তাদের অন্যতম অনুসঙ্গ হয়েই আছেন। জন্মের শুভ মূহুর্ত থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়কে আমরা উদযাপন করতে পারি রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা দিয়ে। আমরা হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করি রবীন্দ্র সম্ভারকে সঙ্গী করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম তাঁর উপন্যাসে মানব মনসত্ব বিশ্লেষণ, রাজনীতি সচেতনতা, প্রাগ্রসর প্রেমচেতনা, আন্তর্জাতিকতা প্রেক্ষাপট নিয়ে এসেছেন। শুধু বাঙ্গলি নয়, তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে আদিবাসী, সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের কথা।

ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরোদ্ধে কবি রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকা, উত্তরকালে তাই বাংলা কবিতায় মহীরুহ হয়ে দেখা দিয়ে দিয়েছে। বাউল গানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মরমি মানবিক উপলব্দির সমর্থন ও প্রেরণার সন্ধান পেয়েছেন। বাউলের গান আর সহজ-সাধনার ভাব একসময়ে রবীন্দ্রমানসে নিবিড়ভাবে মিশে গিয়েছিল। তাইতো তিনি বাউল গানকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্টিত করেছিলেন; সঙ্গে লালন শাহ’কেও। নাট্য-আঙ্গিক সৃজনেও রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ব্যাপক। তিনি নাটকে সংগীত, নৃত্য ও সংলাপের ত্রিমাত্রিক ঐক্য স্থাপন করেছিলেন। প্রবন্ধ নির্মাণেও তিনি নব দিগন্তের সূচনা করেন। যুক্তিবাদিতা, শিল্পিতা আর উপযোগিতা স্থান পেয়েছিল তাঁর প্রবন্ধসাহিত্যে। এভাবেই তিনি সাহিত্যের প্রতিটি শাখাকে নতুন আঙ্গিকে প্রতিষ্টিত করেছিলেন। এবার অন্য প্রসঙ্গ। দেখা যাক রবীন্দ্রাথ কিভাবে আমাদের জীবনঘনিষ্ট বিষয়-আশয়গুলোর সাথে জড়িয়ে ছিলেন এবং আছেন। আজকাল আমরা বৃক্ষরোপণের কথা বলি, পরিবেশের কথা বলি। সেই বৃক্ষরোপণ শব্দটাও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। ক্ষুদ্রঋণের প্রাথমিক ধারণাতো আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকেই পাই। জমিদার হওয়া সত্ত্বেও বহুবছর আগেই তিনি জমিদারদের পুরোনো প্রথা ও অন্যায়-অত্যাচার দূর করে আমূল সংস্কারের জন্য ‘মণ্ডলী প্রথা’র প্রবর্তন করেন। প্রজাদের জন্য কৃষিব্যাংক প্রতিষ্টা, জলসেচ ভাবনা, পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রম- কত ভাবেই তো তিনি আমাদের প্রভাবিত করে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার হলে, রবীন্দ্রনাথও তার অংশীদার। রবীন্দ্রনাথের গান মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল, মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল।

তাঁর কবিতায় দেশপ্রেম আরো প্রগাঢ় হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাইতো ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ আজ আমাদের জাতীয় সংগীত। আমার কাছে রবীন্দ্র সাহিত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হচ্ছে- ধর্মকে পুঁজি করে তিনি সাহিত্য রচনা করেননি, বিশেষ কোন ধর্মকে আশ্র‍্যয় কিংবা প্রশয় দেননি রবীন্দ্রনাথ। তিনি ছিলেন সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের। তাঁর দৃষ্টি ক্ষুদ্র গণ্ডীর বলয় থেকে সর্বদা অগ্রসর হয়েছে বিশ্বায়নের পথে। এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। কোন দেশ বা বিশেষ কোন অঞ্চলের সীমারেখায় তাঁকে আটকে রাখা ন্যায়সঙ্গত হবে না। কারণ তিনি সর্বজনীন।

হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত আমাদের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি আরো বেশি বর্ণিল ও উজ্জ্বল হয়েছে রবীন্দ্র সান্নিধ্যে। স্টাইল আর ফ্যাশন তো তিনিই চিনিয়েছেন আমাদের। বাঙ্গালিকে বিশ্বের দরবারে সবার আগে পরিচয় করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথই। আজ যদি বাঙালিরা সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, অর্থনীতি কিংবা বিজ্ঞানে কিছু অর্জন করে থাকে, তার অগ্রনায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিক্ষক হিসেবে কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী কিংবা শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে আমাকে প্রায়ই শুনতে হয় রবীন্দ্রনাথের রচনা নাকি দুর্বোধ্য, তাঁর সৃষ্টিতে নাকি গতি নেই। অভিযোগ দুটি যে কতটুকু নির্জলা মিথ্যা তা তো রবীন্দ্রনাথের ‘গতিতে জীবন মম, স্থিতিতে মরণ’ – এই একটি চরণ থেকেই তা সহজে অনুমেয়। আর রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বমানের কবির সৃষ্টকে আত্মস্থ করতেও তো একটা প্রাক-প্রস্তুতি দ
দরকার। এটাই তো স্বাভাবিক। শিক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ বিবেচনা করেছেন মানব উন্নয়নের প্রযুক্তি হিসেবে অথচ আমরা আজ শিক্ষাকে বানিয়েছি পণ্য। কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্টানের শিক্ষক রবীন্দ্রচর্চা করেন? তা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ | অথচ এ কথাও সত্য রবীন্দ্রসাহিত্যকে বাদ দিয়ে অন্তত বাংলা সাহিত্য কল্পনা করা অসম্ভব। তরুণ সমাজের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যাশা ছিল বেশি। অথচ সেই তরুণ সমাজের কাছেই রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন, কিছুটা মূল্যহীন। আধুনিকতার কি আছে রবীন্দ্রসাহিত্যে ? এমন ধারণাও পোষণ করেন কেউ কেউ। তাদের জেনে রাখা ভালো রবীন্দ্রনাথ চির নতুন, উত্তরাধুনিক। এমন কোন বাঙালি লেখক নেই, যিনি রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারকে অতিক্রম করেন, কিংবা তাঁর প্রভাব-বলয়ের বাইরে থেকে সাহিত্য চর্চা করতে পারেন। রবীন্দ্রচর্চা আরো বেশি বেগবান হোক শিক্ষা প্রতিষ্টানসহ সর্বত্র। রবীন্দ্রজ্যোতিতে আলোকিত হোক সবাই।

লেখক- পংকজ কান্তি গোপ টিটু
সংস্কৃতিকর্মী, সহকারী শিক্ষক
পুটিজুরী এস.সি. উচ্চ বিদ্যালয়
বাহুবল, হবিগঞ্জ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com